দুই তদারকি সংস্থার অধীনে ২ হাজার ৪৮৪ কারখানার মধ্যে মাত্র ২৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ত্রুটি সংস্কারের কাজ শেষ করেছে।
রানা প্লাজা ধসের পর তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি অনুসন্ধান ও সংস্কারকাজ শুরু হয়। প্রথম পাঁচ বছর এই কার্যক্রম মোটামুটি দ্রুতগতিতে এগোয়। কিন্তু পরে সংস্কারকাজের গতি কমে যায়। ফলে ১১ বছর পার হয়ে গেলেও বেশির ভাগ কারখানার ত্রুটি সংস্কারের কাজ শতভাগ শেষ হয়নি।
শ্রমবিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মপরিবেশ উন্নয়নে আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা কমে আসায় মালিকদের অনেকে সংস্কারকাজে অর্থ খরচে আগ্রহী হচ্ছেন না। তা ছাড়া তদারকি সংস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকায় পুরো কার্যক্রমে ধীরগতি চলছে। তাতে অনেক কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
নতুন নতুন কারখানা নির্মিত হচ্ছে। সেগুলোও পরিদর্শনের আওতায় নিতে হবে। না হলে কোনো একটি কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের ঘাড়ে দায়ভার আসবে।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)।
বর্তমানে আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি) এবং ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিটের অধীনে থাকা ২ হাজার ৪৮৪টি তৈরি পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫ দশমিক ২৮ শতাংশ কারখানার ত্রুটি সংস্কারের কাজ শেষ করেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কারখানার ত্রুটি সংস্কারকাজে আরএসসির তাগিদ কম। সংস্থাটি প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছে না। তা ছাড়া মালিকদেরও গাফিলতি আছে। সে কারণে পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ ধীরগতিতে চলছে।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সাভারের রানা প্লাজার ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনার ৫টি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা যান। আরও অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
রানা প্লাজা ধসের পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে বিদেশি ক্রেতাদের দুটি জোট গঠিত হয়। উভয় জোটের অধীনে বড় ও মাঝারি প্রায় দুই হাজার কারখানার সংস্কারকাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অ্যালায়েন্স চলে যাওয়ার পর তাদের অধীনে থাকা কারখানাগুলো তদারকির জন্য নিরাপন নামে একটি সংস্থা গঠিত হলেও সেটি এখন নেই। আর অ্যাকর্ডের কারখানাগুলো ২০২০ সালের ১ জুন থেকে তদারকি করছে আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)।
বর্তমানে আরএসসির অধীনে তদারকিতে রয়েছে ১ হাজার ৮১৮টি পোশাক কারখানা। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৬৫টি সব ধরনের ত্রুটি সংশোধন সম্পন্ন করেছে। আরও ২১১টি কারখানা সব ত্রুটি সংশোধন করলেও সেগুলোর অনুমোদন বাকি আছে। ২০২০ সালে যখন অ্যাকর্ড বাংলাদেশ ছাড়ে, তখন এই সংখ্যা ছিল ২৭৯। অর্থাৎ গত ৩ বছর ৯ মাসে নতুন করে ২৮৬ পোশাক কারখানায় সব ধরনের ত্রুটি সংশোধন শেষ হয়েছে।
অন্যদিকে ১ হাজার ৮১৮ কারখানার মধ্যে ৫১৬টিতে আগুন শনাক্ত ও সতর্কীকরণ যন্ত্র (ফায়ার অ্যালার্ম অ্যান্ড ডিটেকশন সিস্টেম) বসেছে। আরও ৪৭ কারখানায় এই যন্ত্র বসলেও সেগুলোতে এখনো পরিদর্শন সম্পন্ন হয়নি। অ্যাকর্ড বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গোটানোর সময় ২৯৬ কারখানায় আগুন শনাক্ত ও সতর্কীকরণ যন্ত্র বসেছিল। যদিও তখন অ্যাকর্ডের অধীনে কারখানা ছিল ১ হাজার ৬২৯টি।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুর দিকে আরএসসির কার্যক্রম ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে লোকবল নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা কিছুটা উন্নতি করেছে। আমরা এখনো পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা উন্নতি চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আরএসসিকে আমরা জবাবদিহির মধ্যে আনতে চাই। সার্বিক বিষয়ে আমরা ৩০ এপ্রিল সংস্থাটির বোর্ড সভায় আলোচনা করব।’
এ বিষয়ে আরএসসির বক্তব্য জানতে গত রোববার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মেইল করা হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা কোনো উত্তর দেয়নি।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বাইরে থাকা ১ হাজার ৫৪৯টি কারখানায় জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে পরিদর্শন হয়েছিল। সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে কারখানাগুলোর সংস্কারকাজ তদারকি করেছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। নতুন করে ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিট গঠনের মাধ্যমে সংস্কারকাজ শেষ করার চেষ্টা করছে ডিআইএফই।
ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিটের অধীনে বর্তমানে ৬৬৬টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬৩টি কারখানা শতভাগ সংস্কারকাজ শেষ করেছে। বাকিগুলোর সংস্কারকাজের অগ্রগতি খুবই কম। যদিও ৩১১টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে ডিআইএফইর উপমহাপরিদর্শক আকিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অধীনে থাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে কারখানাগুলোতে বড় ঝুঁকি নেই। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক কারখানা সংস্কারকাজ করছে না। আবার অনেকে কাজ করছেন।’
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ কারখানার সংস্কারকাজ শতভাগ শেষ না হওয়া আরএসসির ব্যর্থতা। অ্যাকর্ডের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে দ্রুতগতিতে কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংস্থাটি।
গাফিলতির কারণেই তারা দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, নতুন নতুন কারখানা নির্মিত হচ্ছে। সেগুলোও পরিদর্শনের আওতায় নিতে হবে। না হলে কোনো একটি কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের ঘাড়ে দায়ভার আসবে।