উপকরণ তৈরিতে স্বনির্ভরতার পথে দেশ

দুই দশক আগেও বাংলাদেশ ইস্পাতের অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন উপকরণের জন্য পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ছিল। ২০০৪ সাল থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে কারখানা স্থাপন করতে শুরু করে। তাতে আমদানি কমতে থাকে।

ইস্পাতের ভবন তৈরির নানা কাঠামো তৈরি হচ্ছে কারখানায়। এসব কাঠামো দিয়ে তৈরি হবে ইস্পাতের ভবন। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরায় কে আর স্টিল স্ট্রাকচার লিমিটেডের কারখানায়

দুই দশক আগেও বাংলাদেশ ইস্পাতের অবকাঠামো নির্মাণের বিভিন্ন উপকরণের জন্য পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ছিল। তখন সৌদি আরবের জামিল স্টিলই ছিল এ দেশের শিল্পকারখানায় বিনিয়োগকারীদের বড় ভরসা। সে সময় দেশে ইস্পাত অবকাঠামো নির্মাণের বিভিন্ন উপকরণ তৈরির কোনো কারখানা ছিল না। এমন ফাঁকা মাঠে বিনিয়োগের বীজ বুনতে শুরু করেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। বদৌলতে দুই দশক পর এখন ইস্পাত দিয়ে কারখানা ভবন নির্মাণে জামিল স্টিলের কথা ভাবতে হয় না বিনিয়োগকারীদের। কারণ, দেশেই এখন ইস্পাত অবকাঠামো নির্মাণের বিভিন্ন উপকরণ তৈরির বড় বড় কারখানা গড়ে উঠেছে।

উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। ২০০৩ সালে সরাসরি ইস্পাত অবকাঠামো নির্মাণের বিভিন্ন উপকরণ আমদানি করে দেশে ৮৫টি কারখানা ভবনসহ অবকাঠামো প্রকল্প স্থাপন করেছিল বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।

এর মধ্যে সৌদি আরবের জামিল স্টিল একাই করেছিল ৪৭টি। তবে ২০০৪ সাল থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে কারখানা স্থাপন করতে শুরু করে। তাতে আমদানি কমতে থাকে। যেমন ২০২২ সালে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে আমদানি করা উপকরণ দিয়ে। এর বিপরীতে দেশীয় কারখানাগুলোয় তৈরি ইস্পাত উপকরণ দিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে এক হাজারের বেশি ভবন বা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বলে এই খাতের নেতারা দাবি করেন।

‘এই খাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসায় আমাদের এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না। যেমন ২০১৭ সালে ফেনীতে ইস্পাত উপকরণ দিয়ে ঢেউটিনের বড় কারখানা ভবন স্থাপন করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান।’
মোহাম্মদ আমির হোসেন, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক

এই খাতের উদ্যোক্তারা জানান, প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, অর্থাৎ অর্ডার তথা ক্রয়াদেশে যে মাপজোক উল্লেখ করা হয়, সে আলোকে ইস্পাত অবকাঠামোর ভবন বা অবকাঠামোর সব উপকরণ তৈরি করা হয়। এরপর উপকরণগুলো প্রকল্প এলাকায় নিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত করে ভবন গড়ে তোলা হয়। এ জন্য এই শিল্পকে বলা হয়, ‘প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল বিল্ডিং’।

বিনিয়োগ ও কারখানা বৃদ্ধি

২০০৪ সালে সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে চট্টগ্রামের পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা ভবন তৈরি করেছিল সৌদি আরবের জামিল স্টিল কোম্পানি। দেশে ইস্পাত অবকাঠামোর উপকরণ তৈরির কারখানা গড়ে ওঠায় পিএইচপি গ্রুপরবর্তীকালে আর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মোহাম্মদ আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই খাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসায় আমাদের এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না। যেমন ২০১৭ সালে ফেনীতে ইস্পাত উপকরণ দিয়ে ঢেউটিনের বড় কারখানা ভবন স্থাপন করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান।’

দেশে ইস্পাত অবকাঠামোর বিভিন্ন উপকরণ তৈরির কারখানা স্থাপন শুরু হয় ২০০৪ সালে। এর পর থেকে ইস্পাতের ভবন নির্মাণের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। ফলে প্রতিবছরই কারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইস্পাত অবকাঠামোর উপকরণ প্রস্তুতকারকদের সংগঠন স্টিল বিল্ডিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এসবিএমএ) তথ্য অনুযায়ী গত বছর তাদের সদস্য কারখানার সংখ্যা ছিল ৩৩, যা এ বছর ৩৬টিতে উন্নীত হয়েছে। সংগঠনের বাইরে আরও অন্তত ২৫০টি ছোট কারখানা রয়েছে বলে জানান এসবিএমএর নেতারা।

এসবিএমএ সূত্রে জানা গেছে, ইস্পাত অবকাঠামোর উপকরণ তৈরির সিংহভাগ কারখানাই গড়ে উঠেছে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকা অঞ্চলে। এর বাইরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কেআর স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ, কুমিল্লায় পিইবি অ্যালায়েন্স লিমিটেড, নোয়াখালীতে স্টিলক্রাফট, সিলেটের হবিগঞ্জে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সিলভান টেকনোলজিস ও টাঙ্গাইলে ইপিইসি নামে কারখানা রয়েছে। ছোট কারখানাগুলোর সিংহভাগই ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত।

কারখানা ভবনই বেশি হচ্ছে

এসবিএমএ সূত্রে জানা গেছে, ইস্পাত অবকাঠামোর উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পকারখানার ভবন, ছাউনি ও গুদামঘরই তৈরি হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পেও ইস্পাতের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণের হার এখনো কম।

উদ্যোক্তারা জানান, ইস্পাতের উপকরণ ব্যবহার করে কারখানার গুদাম বা ভবন তৈরি করলে অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় হয়। এতে সময়ও লাগে খুব কম। তবে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে কংক্রিটের তুলনায় ইস্পাতের ভবন নির্মাণের খরচ প্রায় কাছাকাছি। নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে কংক্রিট ভবনের তুলনায় ইস্পাতের তৈরি ভবন সুবিধাজনক। কারণ, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কংক্রিট ভবনের চেয়ে ইস্পাত অবকাঠামোর ভবন অনেক বেশি নিরাপদ।

‘বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে হট রোলড কয়েল তৈরির মৌলিক কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি আমরা। সেখানে দেশীয় ইস্পাত অবকাঠামো খাতের কাঁচামাল তৈরি হবে। তখন কাঁচামালেও আমদানিনির্ভরতা কমবে।
মোহাম্মদ আমির হোসেন, পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক

সরেজমিন

সম্প্রতি সরেজমিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বড় কুমিরায় কেআর স্টিল স্ট্রাকচার লিমিটেডের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকৌশলীদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী শ্রমিকেরা ইস্পাতের পাত প্রক্রিয়াকরণে ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁরা মধ্যবর্তী কাঁচামাল হট রোলড প্লেট থেকে কলাম-বিমসহ নানা উপকরণ তৈরি করছেন। কারখানাটির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ইস্পাতের পাত থেকে নানা উপাদান তৈরির বেশির ভাগ কাজ হয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী কলাম-বিমসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা হয়।

কারখানাটির কর্মকর্তারা জানান, কারখানায় নানা উপকরণ প্রস্তুত হওয়ার পর আরেকটি শেডে নেওয়া হয়। সেখানে ইস্পাতের পাতের কাঠামোর উপরিভাগ থেকে যন্ত্রের সাহায্যে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ দূর করা হয়। এরপর টেকসই করার জন্য রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া এসব উপাদান সরাসরি অবকাঠামোর নির্মাণস্থলে নেওয়া হয়। সেখানে নকশা অনুযায়ী একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত করে ভবন স্থাপন করা হয়

‘দেশীয় চাহিদার চেয়ে কারখানাগুলোর উৎপাদনক্ষমতা এখন বেশি। এই খাতে আমরা স্বনির্ভর হয়েছি। সরকার এই খাতকে নীতি-সহায়তা দিলে রপ্তানি যেমন বাড়বে, তেমনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা আরও বাড়বে।’
রাশেদ খান, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন স্টিল বিল্ডিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এসবিএমএ) সাধারণ সম্পাদক

কাঁচামাল এখনো প্রায় আমদানিনির্ভর

ইস্পাত অবকাঠামো শিল্পের মূল কাঁচামাল হলো নানা পুরুত্বের ইস্পাতের পাত বা ‘হট রোলড স্টিল প্লেট’। এই কাঁচামালের ৯৮ শতাংশই আমদানি করতে হয়। দেশে হট রোলড স্টিল প্লেট তৈরি করে রহিম স্টিল। তবে তা দেশীয় চাহিদার তুলনায় মাত্র ২-৩ শতাংশ। যোগাযোগ করা হলে রহিম স্টিলের একজন কর্মকর্তা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে জানান, ২০০৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি হট রোলড স্টিল প্লেট তৈরি করে আসছে, যা ইস্পাতের অবকাঠামো ও জাহাজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দেশে চাহিদা বাড়ায় সামনে তাঁদের কারখানা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। 

জানতে চাইলে পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ আমির হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে হট রোলড কয়েল তৈরির মৌলিক কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি আমরা। সেখানে দেশীয় ইস্পাত অবকাঠামো খাতের কাঁচামাল তৈরি হবে। তখন কাঁচামালেও আমদানিনির্ভরতা কমবে।

 সরকারি হিসাবে, বর্তমানে এই খাতে ৩৪ শতাংশ মূল্য সংযোজন হচ্ছে। তবে দেশে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল উৎপাদন হলে মূল্য সংযোজনের হার আরও বাড়বে।

রপ্তানির সম্ভাবনা, দরকার উদ্যোগ

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর রপ্তানির বাজার বাড়ছে। ২০২২ সালে বিশ্বে এই খাতে রপ্তানি বাজারের আকার ছিল ১ হাজার ২৩৩ কোটি ডলার। শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, নেদারল্যান্ডস, চেক প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি। অন্যদিকে শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, হংকং ইত্যাদি। 

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন রপ্তানির সক্ষমতাও আছে দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সে দক্ষতা দেখিয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে বন্ডেন্ড ওয়্যারহাউস বা শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া দরকার। কারণ, বর্তমান শুল্কহারে কাঁচামাল আমদানি করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন।

দেশেও বড় সম্ভাবনা

ইস্পাত অবকাঠামো নির্মাণ খাতে সামনে বড় সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তারা। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ভবিষ্যতে অসংখ্য কারখানা হবে। তাতে প্রচুর ইস্পাতের অবকাঠামো গড়ে উঠবে। কারণ, কম খরচে ও কম সময়ে কারখানার ভবন, গুদাম ও ছাউনি তৈরির সহজ সমাধান দেয় ইস্পাত। 

এই খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন স্টিল বিল্ডিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এসবিএমএ) সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশীয় চাহিদার চেয়ে কারখানাগুলোর উৎপাদনক্ষমতা এখন বেশি। এই খাতে আমরা স্বনির্ভর হয়েছি। সরকার এই খাতকে নীতি-সহায়তা দিলে রপ্তানি যেমন বাড়বে, তেমনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা আরও বাড়বে।’