একসময় ছিল বিনিময় প্রথা, অর্থাৎ এক পণ্যের বিনিময়ে আরেক পণ্য নেওয়া। সেই দিন এখন গত। তবে বিশ্ববাজারে যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয়, তার মূল বিষয়ের সঙ্গে বিনিময় প্রথার বিশেষ কোনো ফারাক নেই। অর্থাৎ যে দেশ যে পণ্য উৎপাদনে পারদর্শী, তারা সেই পণ্য রপ্তানি করে। আর যাদের যেটা প্রয়োজন, তারা সেটা আমদানি করে।
সাধারণভাবে মনে হতে পারে, যেসব দেশ দুর্বল, তারাই বেশি আমদানি করে। কিন্তু বাস্তবতা মোটেও সে রকম নয়। যেমন বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র নানা বিবেচনায় নিজেরা উৎপাদন বন্ধ রেখে বিশ্বের শীর্ষ আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে, যার সঙ্গে বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সংযোগ রয়েছে।
শুরুতে দেখা যাক বিশ্বের শীর্ষ ১০টি আমদানিকারক দেশ কোনগুলো। পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুসারে, বিশ্বের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে এই দেশটি আমদানি করেছে ৩৩ হাজার ৭৬২ বিলিয়ন বা ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ চীন, যারা একই সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক। ২০২২ সালে এই দেশটি ২ হাজার ৭১৬ বিলিয়ন বা ২ লাখ ৭১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ হচ্ছে জাপান, ২০২২ সালে যারা ৮৯৭ দশমিক ২৪ বিলিয়ন বা ৮৯ হাজার ৭২৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। চতুর্থ স্থানে আছে যুক্তরাজ্য, ২০২২ সালে তারা আমদানি করেছে ৮২৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন বা ৮২ হাজার ৩২৩ কোটি ডলারের পণ্য। পঞ্চম স্থানে আছে দক্ষিণ কোরিয়া, ২০২২ সালে এই দেশটি আমদানি করেছে ৭৩১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন বা ৭৩ হাজার ১৩৭ কোটি ডলারের পণ্য।
ষষ্ঠ স্থানে আছে হংকং, গত বছর তারা আমদানি করেছে ৬৬৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন বা ৬৬ হাজার ৭৫৫ কোটি ডলারের পণ্য। সপ্তম স্থানে আছে কানাডা, গত বছর তারা আমদানি করেছে ৫৮১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন বা ৫৮ হাজার ১৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। অষ্টম স্থানে আছে সিঙ্গাপুর, ২০২২ সালে এ দেশটির আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৭৫ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন বা ৪৭ হাজার ৫৫৮ কোটি ডলার। নবম স্থানে আছে তুরস্ক, গত বছর তারা আমদানি করেছে ৩৬৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন বা ৩৬ হাজার ৩৭১ কোটি ডলারের পণ্য। দশম স্থানে আছে ভিয়েতনাম, গত বছর তাদের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৫৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন বা ৩৫ হাজার ৯২৮ কোটি ডলারের পণ্য।
এদের মধ্যে শীর্ষ আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যানবাহন, খনিজ, জ্বালানি, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, পোশাকসহ নানা পণ্য আমদানি করে থাকে। দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানিকারক দেশ চীন ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক, সেমিকন্ডাক্টর প্রভৃতি পণ্য আমদানি করে থাকে।
চীন বিশ্বের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার পরও শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারকও বটে। এর কারণ হলো চীন রপ্তানির জন্য যেসব পণ্য উৎপাদন করে, তার জন্য কাঁচামালের বড় একটি অংশই তাদের আমদানি করতে হয়। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস ও গাড়ির অন্যতম মূল উপাদান হিসেবে পরিচিত সেমিকন্ডাক্টর আমদানি করতে হয় তাদের।
সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন বেশ জটিল, এটি উৎপাদন করতে দক্ষ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় সমন্বয়। আইফোনে যে চিপ ব্যবহৃত হয়, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ডিজাইন করা হয়েছে; তৈরি করা হয় তাইওয়ান, জাপান অথবা দক্ষিণ কোরিয়ায়, তারপর চীনে তা সংযোজন করা হয়। ফলে এই চিপ আমদানি করতে না পারলে চীনের রপ্তানি বাণিজ্য মার খাবে। এই প্রযুক্তির বেশির ভাগই আছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। তারা এখন চীনের উত্থান ঠেকাতে চীনে চিপ রপ্তানি সীমিত করেছে। এতে বিপদে পড়েছে চীন। তাই চীন এখন নিজেরাই চিপ বানানোর চেষ্টা করছে। তাতে কিছুটা সফলও হয়েছে, সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে নিজেদের তৈরি চিপ দিয়ে নতুন স্মার্টফোন বাজারে এনে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিসংখ্যান তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পণ্য উৎপাদন ছেড়ে দিয়েছে। ফলে চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশ এসব পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে গেছে। যেমন অ্যাপল কোম্পানির আইফোন এত দিন মূলত চীনে উৎপাদিত হয়েছে; সেখান থেকে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও এখন রাজনৈতিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র চীন ছাড়ো নীতি গ্রহণ করেছে, সে কারণে আইফোন উৎপাদনকেন্দ্র ধীরে ধীরে ভারতের দিকে চলে আসছে। একইভাবে সেমিকন্ডাক্টরের জন্য তারা এত দিন তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু চীন সেখানে আক্রমণ চালালে কী হতে পারে, সেই ভয়ে তারা এখন ভিয়েতনামকে সহায়তা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে এখন প্রযুক্তি ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে সারা বিশ্বের শেষ ভরসা (ক্রেতা) হিসেবে কাজ করে। বিশ্বের আর্থিক খাতের ওপর তাদের যে নিয়ন্ত্রণ, তার বিনিময়ে তারা এতটা আমদানি করে বলে বিশ্লেষকেরা বলেন। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় ও পারিবারিক ঋণ রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে।
এ ছাড়া শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে জাপান সাধারণত রাসায়নিক, ধাতু ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আমদানি করে। যুক্তরাজ্য, খাদ্য, পানীয়, জামাকাপড় আমদানি করে। সিঙ্গাপুর আমদানি করে আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, স্বর্ণ ও গ্যাস টারবাইন। দক্ষিণ কোরিয়া আমদানি করে অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, আইসি, ফটো ল্যাবের উপকরণ ইত্যাদি। হংকং আমদানি করে আইসি, সম্প্রচার উপকরণ, স্বর্ণ, টেলিফোন ইত্যাদি।
এ ছাড়া কানাডা আমদানি করে মূলত যানবাহন ও যন্ত্রাংশ, পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক ইত্যাদি। তুরস্কের মূল আমদানি পণ্য হচ্ছে লোহা ও ইস্পাত, হীরা ও মূল্যবান ধাতু, যানবাহন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। ভিয়েতনামের মূল আমদানি পণ্য হচ্ছে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক, যানবাহন, কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।