সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সাড়ে ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে।
তৈরি পোশাকের কল্যাণে সদ্য বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছর সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় থাকলেও বড় কয়েকটি খাতের রপ্তানির তথ্য দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। কারণ, পোশাকের পর বড় পাঁচ খাতের রপ্তানি কমে গেছে। এর ফলে এক বছরের ব্যবধানে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানির ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেছে দুটি খাত।
খাত দুটি হলো পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। অন্যদিকে প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি পৌনে এক বিলিয়ন থেকে অর্ধ বিলিয়নে নেমেছে। বর্তমানে তৈরি পোশাক ছাড়া কেবলমাত্র চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং হোম টেক্সটাইলের রপ্তানির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারের বেশি।
রপ্তানিকারকেরা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেসব দেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। সে জন্য ক্রয়াদেশ কমে রপ্তানি কমেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছর ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সাড়ে ৮৪ শতাংশ বা ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
এ ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে।
এদিকে বিদায়ী অর্থবছর তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য বড় পাঁচ খাত ভালো করতে না পারায় সামগ্রিকভাবে দেশের পণ্য রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বিদায়ী অর্থবছরে ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৪৪ কোটি ডলার কম হয়েছে রপ্তানি।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছর চামড়া খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২২ কোটি ডলারের। তার আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে পৌনে ২ শতাংশ।
চামড়া খাতের রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোমেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিক্রি কমায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউতে ব্র্যান্ডগুলোর অবিক্রীত জুতার মজুত বেড়েছে। সে কারণে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়েছে। আমাদের ব্লু ওশান ফুটওয়্যার গত ২০২১-২২ অর্থবছর ৪২ লাখ জোড়া জুতা রপ্তানি করে, যা ত অর্থবছর তা কমে ২৫ লাখ জোড়ায় নেমেছে।’
এদিকে গত ২০২১-২২ অর্থবছর ১৬২ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়। ওই বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪৩ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছর এ রপ্তানি কমে দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ডলারে।
বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান এম শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘সার্বিকভাবে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার কারণেই রপ্তানি কমেছে। আবার কিছু ক্রয়াদেশ হাতছাড়াও হচ্ছে। কারণ, আমাদের প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা ১২-১৩ শতাংশ কম দামে পণ্য বিক্রি করছেন।’
টানা দুই বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার পর বিদায়ী অর্থবছর ধস নেমেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর ৮৪ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম।
জানতে চাইলে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, কাঁচামালের খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছেন কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকেরা। সম্ভাবনাময় এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে কাঁচামালের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের সহযোগিতা দরকার।
গত ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি ডলারের বেশি। সদ্য বিদায়ী অর্থবছর তা কমে ৫৯ কোটি ডলারে নেমেছে। প্রকৌশল পণ্যের মধ্যে রয়েছে ইস্পাত, কপার তার, যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক পণ্য ও বাইসাইকেল।
বাইসাইকেল রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়ে মেঘনা করপোরেশনের পরিচালক মো. লুৎফুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইকেল রপ্তানিতে আমাদের মূল বাজার ইইউ। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এই বাজারে সাইকেলের বিক্রি কমেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমেছে। আবার যেটুকু ক্রয়াদেশ ছিল, তার সবটুকুও গ্যাস–বিদ্যুতের কারণে করা যায়নি। সে কারণেও রপ্তানি কমেছে।’
দুই বছর ধরে এ খাতের রপ্তানি কমছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছর ৯১ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ কম। বিদায়ী অর্থবছর পাট খাতের ৯১ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে কাঁচা পাটের ২০ কোটি, পাটের সুতার ৫০ কোটি এবং পাটের ব্যাগ ও বস্তার ১১ কোটি ডলার রয়েছে। এই তিন উপখাতের রপ্তানি কমেছে ৮ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বলেন, পাটপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বের ক্রেতারাই বিকল্প পণ্যে ঝুঁকছেন। এতে রপ্তানি কমছে।