ডলার–সংকটে আমদানি কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে জাহাজভাঙা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোয়।
ডলার–সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খোলায় যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তার প্রভাব পড়েছে জাহাজভাঙা শিল্পে। সদ্য বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরে পুরোনো জাহাজ আমদানি অস্বাভাবিক কমে ১৪৭টিতে নেমে এসেছে, যা গত ১৯ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আমদানি কমায় এই খাতের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল শিল্পকারখানাগুলোয় উৎপাদনে ভাটা পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস ও জাহাজভাঙা শিল্পের ব্যবসায়ীদের সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে যে ১৪৭টি পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়েছে, সেগুলোতে লোহার পরিমাণ ৯ লাখ ৭১ হাজার টন। এর আগের ২০২১–২২ অর্থবছরে আমদানি হওয়া ২০০ জাহাজে লোহার পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ এক বছরে লোহার পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। এর আগে ২০০৩–০৪ অর্থবছরে সবচেয়ে কম—১০৯টি জাহাজ আমদানি হয়েছিল। সেগুলো ভেঙে পাওয়া গিয়েছিল ৫ লাখ ৭৯ হাজার টন লোহা।
দেশে পুরোনো জাহাজ আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আর আমদানি করে সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলবর্তী জাহাজভাঙা কারখানাগুলো। তারা পুরোনো জাহাজ আমদানির পর সেগুলো ধাপে ধাপে কেটে বিক্রি করে। জাহাজভাঙার পর প্লেট, লোহার টুকরা, সরঞ্জাম ইত্যাদি লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পুরোনো জাহাজের আমদানি কমে যাওয়ায় লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের ছোট কারখানাগুলো কাঁচামাল–সংকটে ভুগছে। অনেকগুলো সনাতন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।মোহাম্মদ সরওয়ার আলম, গ্রুপটির পরিচালক
আমদানিকারকেরা জানান, তিন কারণে পুরোনো জাহাজ আমদানি কমেছে। প্রথমত, পুরোনো জাহাজের ঋণপত্র খুলতে অর্ধকোটি থেকে কয়েক কোটি ডলার দরকার হয়। এ জন্য এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি লাগে। আবার ব্যাংকগুলোও ডলার–সংকটের কারণ দেখিয়ে বড় ঋণপত্র খুলতে নিরুৎসাহ দেখায়।
দ্বিতীয়ত, ডলার পরিশোধে অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশি ব্যাংকের অনীহায় ইউপাস ঋণপত্র খুলতে সময় বেশি লাগে। তৃতীয়ত, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিকারকেরা লোকসানের মুখে পড়েন। এক বছর আগে ডলারের দাম ছিল ৯৪-৯৫ টাকা, যা এখন বেড়ে ১০৭ থেকে ১১৪ টাকা হয়েছে।
জাহাজভাঙা শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ডলার–সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা থাকার কারণে জাহাজ আমদানি কমেছে। এক–দেড় বছর আগেও যেখানে ৩০–৩৫টি প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ছিল, সেখানে এখন তা ১৫টিতে নেমে এসেছে। অবস্থা এমন হয়েছে, সরকার সহযোগিতা না করলে জাহাজভাঙা শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
এদিকে বড় অঙ্কের ঋণপত্র খুলতে না পেরে কিছু আমদানিকারক ছোট ছোট জাহাজ আমদানি করেন। গত অর্থবছরে প্রতিটি জাহাজে গড়ে লোহার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬০৫ টন। আগে জাহাজপ্রতি লোহার গড় পরিমাণ ছিল ১১–১২ হাজার টন। আগে যেখানে ৩০ হাজার টনের চেয়ে বেশি পণ্যবাহী পুরোনো বড় জাহাজ আমদানি হতো গড়ে ২০টি করে, সেখানে গত বছর হয়েছে মাত্র চারটি।
উদ্যোক্তারা জানান, পুরোনো জাহাজের প্লেট, লোহার ভারী ও ছোটখাটো টুকরা, বাতিল যন্ত্রাংশ, জেনারেটর ও যন্ত্রপাতি, নাটবল্টু, আসবাব, রান্নাঘরের জিনিসপত্র বিক্রি হয়। এগুলোকে ঘিরে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বাজার গড়ে উঠেছে। পুরোনো জাহাজের লোহার প্লেট দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথে জাহাজ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড ও রড তৈরির কারখানা রয়েছে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের। গ্রুপটির পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো জাহাজের আমদানি কমে যাওয়ায় লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের ছোট কারখানাগুলো কাঁচামাল–সংকটে ভুগছে। অনেকগুলো সনাতন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের ওপর নির্ভরশীল স্বয়ংক্রিয় কারখানাগুলোও বিপদে পড়েছে। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এই শিল্পের এগিয়ে যাওয়া কঠিন।