রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোয় কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। অন্যদিকে রড, সিমেন্টসহ সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। এ কারণে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে গেছে। এতে চলতি বছর রাজধানীতে ৭০-৮০ লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাটের চাহিদা কমেছে। তবে রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোয় কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেনি।
আবাসন খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী বললেন, দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকলেও অভিজাত এলাকাগুলোয় কয়েক কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাটের বেচাবিক্রিতে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। ফলে উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট নির্মাণ করে, এমন আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা এখন ভালো। অভিজাত এলাকার বাইরে এক কোটি টাকার কম দামের ফ্ল্যাটের তেমন ক্রেতা নেই। এ জন্য ছোট ও মাঝারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়ে মন্দাভাব যাচ্ছে। এ ছাড়া নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য ও নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ভবন নির্মাণে উচ্চতাসংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে আবাসন খাতের পরিস্থিতিকে জটিল করছে।
দেশের আবাসন খাতে উচ্চ, মধ্যম ও তুলনামূলক কম দামের ফ্ল্যাটের চাহিদা ও জোগান কেমন, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। একটি বৈশ্বিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০টি ফ্ল্যাট তৈরি করেছে বাংলাদেশের আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে উচ্চ ও মাঝারি দামের তথা অভিজাত ফ্ল্যাট ৭৪ হাজার ৪২৯টি। এ ধরনের ফ্ল্যাট এক কোটি থেকে কয়েক কোটি টাকা দামে বিক্রি হয়।
একশ্রেণির মানুষের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে। তাঁদের কাছে ফ্ল্যাটের দাম কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনো সমস্যা নয়। অন্যদিকে সমাজের নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ আর্থিকভাবে চাপে পড়ায় কোটি টাকার কম দামের ফ্ল্যাট বিক্রি কমেছে।সোহেল রানা, সহসভাপতি, রিহ্যাব।
দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি আবাসন প্রতিষ্ঠান অভিজাত এলাকায় কয়েক কোটি টাকার দামে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, কনকর্ড, র্যাংগস প্রোপার্টিজ। কোম্পানি তিনটির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর তাঁদের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেনি। তবে আরেক উচ্চ মূল্যের ফ্ল্যাট নির্মাতা রূপায়ণ সিটি উত্তরার একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছর ভালো ব্যবসা করলেও এবার তাঁদের ব্যবসা কিছুটা কম।
জানতে চাইলে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটের বিক্রি ভালো। কারণ, সমাজের একশ্রেণির মানুষের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে। তাঁদের কাছে ফ্ল্যাটের দাম কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনো সমস্যা নয়। অন্যদিকে সমাজের নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ আর্থিকভাবে চাপে পড়ায় কোটি টাকার কম দামের ফ্ল্যাট বিক্রি কমেছে।
গত আগস্টে ঢাকা মহানগরের জন্য নতুন ড্যাপ (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) অনুমোদন দেয় সরকার। তাতে গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকা ছাড়া অধিকাংশ এলাকায় বর্তমানের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। যেমন উত্তরায় তিন কাঠার একটি প্লটে সর্বোচ্চ সাততলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। অর্থাৎ নতুন ড্যাপ অনুযায়ী সেখানে আর ছয়তলার বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে না।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে নতুন আবাসন প্রকল্প পাস হওয়ার হার কমে গেছে। জমির মালিকেরা আগের চেয়ে কম ফ্ল্যাট পাবেন বলে নতুন প্রকল্পে সাইন করছেন না।
ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, কলাবাগান, মোহাম্মদপুর, আদাবর, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে ৫০টি আবাসন প্রকল্প চলমান রয়েছে ক্রিডেন্স হাউজিংয়ের। এলাকা ও আকারভেদে তাদের ফ্ল্যাটের দাম পৌনে দুই কোটি থেকে কয়েক কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুর করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি স্থিতিশীল থাকলেও আমরা গত ছয় মাসে রাজউক থেকে মাত্র নতুন দুটি প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছি। সেই দুটি প্রকল্পও নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার আগে জমা দেওয়া ছিল। নতুন ড্যাপ কার্যকরে পর কোনো প্রকল্প পাস করাতে পারিনি। অন্যদিকে সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দামও বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম নিয়ে আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি।’
২০১১ সালে আবাসন ব্যবসায়ে নামে ইনটেক প্রোপার্টিজ। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি ১০০ ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেছে। বর্তমানে তাদের তিনটি প্রকল্প নির্মাণাধীন। প্রতিষ্ঠানটি মূলত মিরপুর ও কল্যাণপুর এলাকায় কোটি টাকার চেয়ে কম দামের ফ্ল্যাট নির্মাণ করে।
ইনটেক প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘ফ্ল্যাটের বিক্রি ভয়াবহভাবে কমে গেছে। গত বছরের প্রথম আড়াই মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের নির্মাণ খরচও বেড়ে গেছে। আবার নতুন প্রকল্প সাইন করতে পারছি না। নতুন ড্যাপ হওয়ার পর আবাসন প্রকল্প পাসও করানো যাচ্ছে না।’
নতুন আবাসন প্রকল্প পাস হওয়া না–হওয়ার বিষয়ে রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা বলেন, গত ছয় মাসে পুরোনো ড্যাপে ৮০০ আর নতুন ড্যাপে ১০০-এর কাছাকাছি আবাসন প্রকল্প পাস করেছে রাজউক। ড্যাপ সংশোধনে একটি কমিটি হয়েছে। কী কী সংশোধন আসছে, সেদিকে অনেকে তাকিয়ে আছেন। তাই মধ্য ঢাকার জমির মালিকদের বড় অংশই নতুন আবাসন প্রকল্পে যেতে চাচ্ছেন না।
এক বছর আগেও প্রতি টন রডের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে সেটি বেড়ে লাখ টাকার ঘরে। আবার এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ৪৩০ টাকা বেড়ে ৫৩০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একইভাবে পাথর, ইট, বালু, বৈদ্যুতিক তার, টাইলস, স্যানিটারিওয়্যারসহ সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দামই বেড়েছে। তাতে কমবেশি সব আবাসন প্রতিষ্ঠানই ফ্ল্যাটের দাম ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
একটি শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান নির্মাণসামগ্রীর দাম হিসাব-নিকাশ করে প্রথম আলোকে জানায়, প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের নির্মাণ খরচ ৪৪০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তাতে অভিজাত প্রকল্পের ফ্ল্যাটের শুধু নির্মাণ ব্যয় প্রতি বর্গফুটে ৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৫০০ টাকায় উঠেছে।
রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে ভাবছেন, ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়বে। সে কারণে যাঁরা কিনতে চাইছেন তাঁরা কিনে ফেলছেন। তাতে অভিজাত এলাকার আবাসন প্রকল্পের ফ্ল্যাটের ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য এলাকার আবাসন প্রকল্পের বিক্রি কমে গেছে। সে কারণে সামগ্রিকভাবে আবাসন খাতের ব্যবসা ভালো নয়। তিনি আরও বলেন, সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। তাতে ফ্ল্যাটের দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো।