এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় পেছানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়শীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আছে কি না, সে–সংক্রান্ত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পর এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দরকার। কারণ, আগের তথ্য-পরিসংখ্যান ভুল ছিল। অনেক কিছুতে গোঁজামিল ছিল।

জাতীয় রপ্তানির ধারা অব্যাহত রাখতে রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক সংগঠনের এ মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এ কথাগুলো বলেন। তাঁরা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বন্ধে সংস্কার দাবি করেছেন। একই সঙ্গে সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করার অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন তাঁরা।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আজ সোমবার এ সভার আয়োজন করে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্য সরবরাহকারী কারখানামালিকদের সংগঠন বিজিএপিএমইএ। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনটির সভাপতি মো. শাহরিয়ার। উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু।

এলডিসি থেকে উত্তরণ ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া দরকার বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থায়নের সুযোগ ও জিএসপি প্লাসের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং সেই বিনিয়োগের জোগান দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই দেশের ব্যাংকিং খাত। ফলে এখন এলডিসি থেকে উত্তরণের দরকার নেই। এনবিআরের নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতির লাগাম টানতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করব।’

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর নতুন সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘নতুন সরকার সার আমদানি বাড়াবে। এর বিপরীতে শিল্প খাতে গ্যাসের বরাদ্দ বাড়াবে। কারণ, সার উৎপাদনের চেয়ে আমদানি লাভজনক। এত দিন বিষয়টি কেন মাথায় ঢোকেনি?’ গত বছরের শুরুতে গ্যাসের দাম একলাফে দ্বিগুণ করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এভাবে আমাদের অত্যাচার করা হয়েছে। প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে গ্যাসের দাম বাড়লে তা সহনীয় হয়।’

আলোচনার এক পর্যায়ে বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে রাজনীতিকরণ নিয়ে কথা বলেন কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা। তাঁরা বলেন, যখন প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম একলাফে ৩০ টাকা করা হলো, তখন ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলেননি বাণিজ্য সংগঠনের নেতারা। বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার দাবি তোলেন তাঁরা।

বাংলাদেশ সুইং থ্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাসেম হায়দার বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা অনেক দিন মনের কথা বলতে পারেননি। বাণিজ্য সংগঠনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলেছেন। এফবিসিসিআই থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে হবে। বিজিএমইএও অনেক দিন ধরে দলীয় রূপ নিয়েছে। এটিকেও ব্যবসায়িক সংগঠনে পরিণত করুন।’

ব্যবসায়ীদের ওপর কাস্টমসের অত্যাচার গত তিন বছরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান এম শাহদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, এনবিআরের চেয়ারম্যান কোনো ব্যবসায়ীর কথা শোনেননি। অথচ তিনি রাষ্ট্রের কর্মচারী। কাস্টমসের দুর্নীতি অনতিবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।

চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (বিইএ) সহসভাপতি শফিউল্লাহ চৌধুরী বলেন, শিল্পকারখানা এখনো পুরোপুরি চালু হতে পারেনি। এরই মধ্যে নতুন করে চাঁদাবাজি দেখা যাচ্ছে। কারখানার ঝুট নিতে নতুন গ্রুপ দেনদরবার শুরু করেছে।

নিরাপত্তার অভাবে কারখানার গুদামে পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব। তিনি বলেন, অনেক উদ্যোক্তা অর্থাভাবে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না। দুই মাসের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হোক। তিনি আরও বলেন, এনবিআরকে ঢেলে সাজাতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত দপ্তরগুলোতে শিল্পবিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।

দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যবসায়ীরা একত্র না হতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো উন্নতি হবে না বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বলেন, ‘যখন একটা দেশে গণতন্ত্র থাকে না, তখন বেশি উল্লাসের কারণ নেই। আমরা এখন একটা সরকারকে ফেলে দিয়েছি। এখানে আমাদের (ব্যবসায়ী) কারও কোনো অবদান নেই। বিএনপিরও কোনো অবদান নেই। পেছন দিকে থাকতে পারে।’

পরিসংখ্যান বিভাগকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলে মন্তব্য করেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগ করে রাখা হয়েছে। তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাই ঘটুক না কেন প্রতিবছর ৬-৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে হবে। ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সেটিকে বাড়িয়ে দেখাতে হবে।

সবার অধিকার সুরক্ষিত করতে ‘নতুন সংবিধান’ দরকার বলে মন্তব্য করে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যেই ক্ষমতায় আসুক, তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে। অন্যায় করলে বিচার করতে হবে। আইনের সমপ্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়াকে একধরনের পশ্চাৎমুখী আইন বলে সমালোচনা করেন তিনি।

বিপিজিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহে শিল্পকারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তাঁদের সহায়তা করার অনুরোধ রইল। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পেতে আমাদের সময় ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দরকার।’