বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি আরও আগে শুরু হলেও এসব গাড়ির নিবন্ধন দেওয়া শুরু হয় মাত্র গত বছর থেকে। তবে অনেক দামে বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন বৈদ্যুতিক গাড়ি জনপ্রিয় হচ্ছে, তখন বাংলাদেশেও এ ধরনের গাড়ির আমদানি ধীরে ধীরে হলেও বাড়তে শুরু করেছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা কেটে যাওয়ার পর আমদানি বাড়ছে। এক-দুটি থেকে শুরু করে এ ধরনের গাড়ির আমদানি এখন অর্ধশতাধিক ছাড়িয়ে গেছে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত টেসলা। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এই বৈদ্যুতিক গাড়িও এখন বাংলাদেশের রাস্তায় চলছে। সংখ্যায় কম হলেও পথ চলতে পথচারীর চোখে পড়তে পারে এ ধরনের গাড়ি। তবে শুধু টেসলাই নয়, ইউরোপের অডি, মার্সিডিজ কিংবা পোরশে ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়িও চলছে দেশের রাস্তায়।
বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার এখন বেশ বড় হলেও বাংলাদেশে এত দিন এ ধরনের গাড়ি খুব একটা আমদানি হয়নি। গাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি শুরু হলেও প্রায় পাঁচ বছর বৈদ্যুতিক গাড়ির কোনো নিবন্ধন পাননি ক্রেতারা। ফলে নিবন্ধনবিহীন গাড়ি পুলিশের চোখ এড়াতে কম দূরত্বের যাতায়াতে চালাতেন ব্যবহারকারীরা। জানাজানি যাতে কম হয়, সে জন্যই এ পন্থা বেছে নেন বৈদ্যুতিক গাড়ির মালিকেরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রথম টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি হয় ২০১৭ সালে। ঢাকার রয়েল মোটরস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা গাড়িটির আমদানিমূল্য ছিল প্রায় ৮২ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড বা ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। শুল্ক–করসহ গাড়িটি আমদানিতে খরচ পড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এটিসহ এখন পর্যন্ত টেসলার পাঁচটি বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে টিবিএইচ কোম্পানি দুটি গাড়ি এবং বিগ অটোমোবাইলস ও আরপিএম মোটরস একটি করে টেসলা গাড়ি আমদানি করেছে।
বিশ্বজুড়ে অবশ্য টেসলা গত বছর ১৩ লাখ ১৩ হাজার গাড়ি বিক্রি করেছে, আয় করেছে সাড়ে ৮১ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ১৫০ কোটি ডলার (৮ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা)। টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী।
টেসলা আমদানির বিষয়টি এত দিন অপ্রকাশিত থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে প্রথম জার্মানির বৈদ্যুতিক অডি গাড়ির বাজারজাত শুরু হয়েছে। অডি গাড়ির পরিবেশক প্রোগ্রেস মোটরস ইম্পোর্টস লিমিটেড গত মাসে ‘অডি ই-ট্রন’ ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারজাতের ঘোষণা দেয়। এ পর্যন্ত ২৮টি গাড়ি আমদানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ‘অডি ই-ট্রন’ গাড়ি একবার চার্জ দিলে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চালানো যায়। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর খুব কম সময়ে এটিতে গতি ওঠানো যায়।
প্রোগ্রেস মোটরস ইম্পোর্টস লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ফজলে সামাদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশবান্ধব ‘অডি ই-ট্রন’ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বাজারজাত করা বৈদ্যুতিক গাড়ি। এই ব্র্যান্ডের প্রতিটি গাড়ির দাম ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। তিনি বলেন, আগামী ২০৩০ সালের পর ইউরোপে তেলচালিত গাড়ি বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশেও বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার আরও বড় হবে।
টেসলা ও অডি ছাড়াও পোরশে ব্র্যান্ডের ৯টি ও মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের আরও ৯টি বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি হয়েছে দেশে। এ ছাড়া এমজি জেডএস ব্র্যান্ডের দুটি বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি হয়েছে। পোরশে ব্র্যান্ডের টাইক্যান মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানিমূল্য পড়েছে ৫৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার ডলার। গাড়িভেদে শুল্ক, করসহ একেকটির আমদানিতে খরচ হচ্ছে ১ কোটি ৩৬ লাখ থেকে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা পর্যন্ত। মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে কমবেশি দেড় কোটি টাকা খরচ পড়ছে। তবে এসব গাড়ি আমদানিমূল্যের চেয়ে বেশি দামেই বাজারে বিক্রি হয়।
বিলাসবহুল এসব গাড়ির ক্রেতাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে চান না গাড়ির বিক্রেতারা। বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতাদের নাম ও গাড়ির দাম প্রকাশ করতে অনীহা থাকায় তাঁরা এ তথ্য দিতে চান না। তবে এখন পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্রেতারা সবাই উচ্চবিত্ত শ্রেণির।
গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি ও অটো মিউজিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিব উল্লাহ পোরশে টাইক্যান ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছরের বেশি সময় আগে থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি শুরু হলেও দীর্ঘদিন পর এই ধরনের গাড়ির নিবন্ধন শুরু হয়েছে, যা ইতিবাচক দিক। তবে তিনি বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য পার্কিং লটে ও বহুতল ভবনের নিচে চার্জিং স্টেশন বসাতে হবে। এ জন্য প্রণোদনা দেওয়া দরকার। তাহলে পরিবেশবান্ধব এই যানের ব্যবহার বাড়বে। একই সঙ্গে দূষণও কমবে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঢাকার দুটি অঞ্চল থেকে টেসলাসহ আটটি বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সিলিন্ডার ক্যাপাসিটির পরিবর্তে কিলোওয়াট হিসেবে এসব গাড়ির নিবন্ধন দেওয়া হয়। বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০২২ সাল থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ির নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা নেই বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশে একসময় শতভাগ গাড়িই ছিল জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত। এরপর আসে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের সমন্বয়ে চালিত হাইব্রিড গাড়ি। তবে দেরিতে হলেও দেশের সড়কে নেমেছে বৈদ্যুতিক গাড়ি।
বর্তমানে দেশে তেলচালিত গাড়ির বাজারে এখনো কম দামি গাড়ির অংশই বেশি। তবে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানি শুরু হয়েছে দেড় কোটি টাকার চেয়ে বেশি দামি গাড়ি আমদানির মধ্য দিয়ে। দেড় কোটি থেকে তিন কোটি টাকা দামের বৈদ্যুতিক গাড়িই এখন পর্যন্ত দেশে এসেছে। এমন সময়ে দামি এসব গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে, যখন দেশে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হচ্ছে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন কেউ কেউ এই সময় ভালো মুনাফা করে। কিছু মানুষের হাতে নানাভাবে টাকা আসে। অর্থনীতি সমস্যায় পড়লে সবার ওপর সমান অভিঘাত যে পড়ে না, দামি গাড়ি আমদানির চিত্র তা–ই প্রমাণ করে। বাংলাদেশে আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য যে বাড়ছে, আমদানি থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।