কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি আর গ্যাস–সংযোগের অভাবে হারাতে বসেছে বগুড়ার অ্যালুমিনিয়াম শিল্প। জেলার তালোড়া বন্দর এলাকায় সাত দশক আগে গড়ে ওঠা এ শিল্প এলাকার অধিকাংশ কারখানা এখন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
এক সময় এ এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টির বেশি কারখানা ছিল। এর মধ্যে ২৫টি ছিল বড় কারখানা। বড় কারখানাগুলোর মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র একটি। আর ছোট ছোট কারখানা চালু আছে ৮ থেকে ১০টি। চালু থাকা কারখানাগুলোও এখন অস্তিত্বসংকটে ভুগছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ২০০০ সালের পর থেকে গত ২২ বছরে এ এলাকার ছোট-বড় প্রায় ৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, একসময় অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রীর ব্যাপক কদর থাকলেও যুগের সঙ্গে কমতে থাকে চাহিদা। অ্যালুমিনিয়ামের বদলে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও সিরামিক সামগ্রীর কদর বেড়েছে ঘরে ঘরে। তাতে একদিকে কমেছে অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রীর চাহিদা অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাঁচামালের দাম। আবার তালোড়া বন্দর এলাকার অ্যালুমিনিয়াম কারখানাগুলো বছরের পর বছর চেষ্টা করেও গ্যাস–সংযোগ পায়নি। ফলে গত সাত দশকে এ এলাকার প্রায় দুই ডজন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরের এলাকা তালোড়া বন্দর। ১৯৫২ সালে এ এলাকায় প্রথম বড় অ্যালুমিনিয়াম কারখানা গড়ে তোলেন ভারতের রাজস্থানের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী হীরালাল আগরওয়ালা ও তাঁর ভাই লালু রাম আগরওয়ালা। তাঁদের গড়ে তোলা ‘খেতওয়াত অ্যালুমিনিয়াম’ কারখানাটির মালিকানা বদল হয় ১৯৬৫ সালে। এরপর নাম বদলে মোল্লা অ্যালুমিনিয়াম নামে বেশ কয়েক দশক ভালোভাবেই ব্যবসায় টিকে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০ সাল থেকে নানা সংকটে একের পর এক অ্যালুমিনিয়াম কারখানা বন্ধ হতে শুরু করে।
মোল্লা অ্যালুমিনিয়ামের কর্ণধার লতিফুল কবির পবলেন, এ শিল্পের কাঁচামাল ‘অ্যালুমিনিয়াম ইনগট’ চুল্লিতে গলিয়ে পাত তৈরিতে দরকার হয় পাইপ লাইনের গ্যাস। গ্যাস ছাড়া এ শিল্প রক্ষা করা সম্ভব নয়। বগুড়ায় গ্যাস সংযোগ আসার পর থেকে অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় গ্যাস–সংযোগের জন্য নানা জায়গায় ধরনা দিয়েছি। কিন্তু সংযোগ না পেয়ে লোকসানের মুখে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।
লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২০১৫ সালের দিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এ এলাকার রয়্যাল অ্যালুমিনিয়াম নামের আরেক কারখানা। চালু থাকা অবস্থায় কারখানাটিতে মাসে গড়ে ২১ হাজার কেজি অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র তৈরি হতো। কারখানাটিতে কাজ করতেন শতাধিক শ্রমিক। প্রতিষ্ঠানটির মালিক গৌরী শংকর পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন,পঞ্চাশের দশক থেকে দেশের অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের বাজারে দাপট ছিল তালোড়ার পণ্যের। ২০০১ সালের পর বগুড়ায় গ্যাস আসার পর কিছু ব্যবসায়ী গ্যাসনির্ভর অ্যালুমিনিয়াম কারখানা গড়ে তোলেন। কিন্তু তালোড়ার কারখানায় গ্যাস–সংযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ গ্যাসচালিত কারখানার তুলনায় আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ ছিল ৩০ শতাংশের বেশি।
বর্তমানে তালোড়ায় বড় কারখানাগুলোর মধ্যে সচল আছে সৌরভ অ্যালুমিনিয়াম। ১৯৯৬ সালে কারখানাটি চালু হয়। এ কারখানায় অ্যালুমিনিয়ামের বড় ডেকচি, সসপেন, হাঁড়ি-পাতিল, বালতি, কড়াইসহ নানা ধরনের তৈজসপত্র তৈরি হয়। নানামুখী সংকটের মধ্যেও চালু থাকা এ কারখানাটিও এখন ধুঁকছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ প্রসাদ প্রথম আলোকে বলেন, এক যুগ আগেও ফার্নেস তেলের প্রতি লিটারের দাম ছিল সাত টাকা। এখন তা ১০০ টাকা। অ্যালুমিনিয়ামের কাঁচামাল ইনগটের দামও বাড়তি। ফলে গ্যাসচালিত কারখানার তুলনায় আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি। অথচ পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে সমান দামে। তাতে লোকসান দিয়ে কোনো রকমে কারখানাটি চালু রেখেছি।