● বৃহৎ শিল্প বলতে যা বোঝায়, বিস্কুটের তেমন কারখানা রয়েছে ১৫টির মতো।
● ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু অলিম্পিক আড়াই হাজার কোটি টাকার বিস্কুট বিক্রি করেছে।
● বিস্কুটের চাহিদার ৯৫ শতাংশের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানই জোগান দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে বিস্কুটের বাজার বেশ বড়। দেশের মানুষ বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিস্কুট ও সমজাতীয় পণ্য কেনে। মানুষের চাহিদাকে মাথায় রেখে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নানা স্বাদের বিস্কুট বাজারে আনছে।
বিস্কুটের বাজার কত বড়, তার ধারণা পাওয়া যায় এ খাতে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের বিক্রির পরিমাণ দেখে। প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত। তাদের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অলিম্পিক আড়াই হাজার কোটি টাকার বিস্কুট বিক্রি করেছে দেশের বাজারে। পাশাপাশি ২৬ কোটি টাকার বিস্কুট ও সমজাতীয় পণ্য তারা রপ্তানি করেছে।
বিস্কুটের বাজার এত বড় হওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে এ খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশের মানুষের আয় বাড়িয়েছে। যখন আয় বাড়ে, তখন মানুষ মূল খাদ্য ভাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার গ্রহণও বাড়ে।
এখন মানুষ চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খায়। সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবারের মাঝে শিঙাড়া, সমুচার পরিবর্তে অনেকেই দু-চারটি বিস্কুট খেয়ে নেন। বিকেলেও স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বিস্কুট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে দুটি বিস্কুট, একটি কলা অথবা এক কাপ চা পেট ভরানোর ভালো উপায়। ফলে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানগুলোয় থাকে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট।
অবশ্য বিস্কুটের বাজারে বহু বছর টানা প্রবৃদ্ধির পর এ বছর কিছুটা ভাটার টানই দেখা যাচ্ছে। উৎপাদকেরা বলছেন, বিস্কুটের প্রধান উপকরণ ময়দা, চিনি ও ভোজ্যতেলের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের দামের কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিস্কুটের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, দাম বেড়েছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এসব কারণে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।
বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্রুপ রিদিশার পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) এম এ খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিস্কুট তৈরির প্রধান তিন উপকরণের (ময়দা, চিনি ও তেল) দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিস্কুটশিল্পের জন্য এটি বড় সমস্যা। তিনি আরও বলেন, দেশে বিস্কুটের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। বিগত কয়েক বছরের বিবেচনায় বলা যায়, এই বাজার বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
বড়দের বিনিয়োগ
দেশে একসময় বিস্কুট তৈরি করত পাড়া-মহল্লার বেকারিগুলো। ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বই বলছে, ১৯৬৪ সালে ঢাকা জেলায় ১৯টি বেকারি ছিল। তখন অবশ্য কিছু বড় প্রতিষ্ঠানও ছিল। ব্যারিস্টার তমিজুল হক ১৯৪৭ সালে ঢাকার তেজগাঁওয়ে বিস্কুটের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। হক বিস্কুট এখন বাজারের বড় ব্র্যান্ডগুলোর একটি। আর নাবিস্কোও স্বাধীনতার আগে থেকে বিস্কুট উৎপাদন করছে। এরপর বিস্কুট উৎপাদনে যুক্ত হয় মাসাফি, আজাদ নামের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অলিম্পিক, যেটি এখন বাজারের সবচেয়ে বড় বিস্কুট উৎপাদনকারী।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিবিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোট-বড় পাঁচ থেকে ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান বিস্কুট উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে ১০০টির মতো প্রতিষ্ঠানের স্বয়ংক্রিয় কারখানা রয়েছে। ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড় হিসেবে গণ্য হয়। বৃহৎ শিল্প বলতে যা বোঝায়, বিস্কুটের তেমন কারখানা রয়েছে ১৫টির মতো।
অলিম্পিক, হক, নাবিস্কো, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড, রিদিশা, আকিজ, ফ্রেশ, ড্যান ফুডস, ইস্পাহানি—এগুলোই বিস্কুটের বাজারে এখন বড় ব্র্যান্ড। বিস্কুট খাতে সাম্প্রতিক বড় বিনিয়োগকারী আকিজ ও রিদিশা। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে বিস্কুট উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের শিল্পগোষ্ঠী আকিজ ইনসাফ গ্রুপ। এ জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে আকিজ বেকার্স লিমিটেড নামের নতুন প্রতিষ্ঠান গড়েছে তারা। এর আগে ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদনে আসে রিদিশা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড।
আমদানিনির্ভরতা কমেছে
দেশের বাজারে একসময় বিদেশি বিস্কুট কোম্পানির আধিপত্য ছিল। ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর বিস্কুট আমদানি হতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে দেশের বাজারে বিস্কুটের যে চাহিদা, তার ৯৫ শতাংশের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানই জোগান দিয়ে থাকে। দাম বেশি হওয়ায় বিদেশি বিস্কুট বাজার হারিয়েছে। বিপরীতে দেশেই এখন বিশ্বমানের বিস্কুট উৎপাদন করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
ড্যান ফুডস লিমিটেড ২০১৫ সালে ডেনমার্কের ড্যান কেক এ/এস ও বাংলাদেশের পাণ্ডুঘর গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন বিভাগের প্রধান (হেড অব মার্কেটিং) শাহীদ বিন সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশেই তাঁরা বিস্কুট উৎপাদন করছেন। গবেষণা করে তাঁরা দেখেছেন, আমদানি করা বিস্কুট এবং তাঁদের উৎপাদিত বিস্কুটের মান ও স্বাদ একই।
নতুন নতুন স্বাদের বিস্কুট
একসময় বিস্কুট বলতে শুধু ময়দা, চিনি ও ভোজ্যতেলের মিশেলে তৈরি খাবারকে বোঝাত। এখন নানা স্বাদের বিস্কুট বাজারে এসে গেছে। বাদামের স্বাদ, দুধের স্বাদ, ঘি ও মাখনের স্বাদ, বিভিন্ন ফলের স্বাদ, চকলেটের স্বাদ, পিৎজার স্বাদ, মসলার স্বাদ, আলুর স্বাদ ইত্যাদি স্বাদের বিস্কুট দেশেই তৈরি হয়। জিরার স্বাদের বিস্কুটও এখন দেশে তৈরি হয়। কখনো খেয়ে দেখেছেন কি?
কোম্পানিগুলো বলছে, তারা নতুন নতুন স্বাদের বিস্কুট তৈরিতে গবেষণা করে এবং বাজারে ছাড়ে। এর মধ্যে কিছু কিছু স্বাদের বিস্কুট ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। যেমন প্রাণের পটাটা বিস্কুট ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও এটি মানুষ পছন্দ করেছে। হজমসহায়ক ডাইজেস্টিভ বিস্কুট এখন অনেকের কাছে জনপ্রিয়।
ছোট ছোট বেকারিও বিস্কুটে বৈচিত্র্য এনেছে। ফলে নানা স্বাদের বিস্কুট খেতে পারছে স্বল্প আয়ের মানুষও। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চা-দোকানি মো. রুবেল প্রথম আলোকে জানান, তাঁর দোকানে নোনতা ও মিষ্টি স্বাদ এবং ড্রাই কেক মিলিয়ে ছয় ধরনের বিস্কুট রয়েছে। যেগুলোর প্রতিটির মূল্য ৫ টাকা করে। ক্রেতারা চায়ের সঙ্গে, কেউ কলার সঙ্গে এসব বিস্কুট খেয়ে থাকেন।