বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধা কোথায়; তা উঠে এল দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের কণ্ঠে। কেউ বলেছেন এক যুগেও মেলেনি কারখানায় গ্যাস–সংযোগ। কেউ বলেছেন বিদেশি নাগরিকের কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) পেতে দেরি হয়। কেউ বলেছেন বিদেশি উদ্যোক্তাদের জমির ইজারা পেতে জটিলতার কথা। কেউ জানিয়েছেন বন্দরে শুল্ক জটিলতার অভিজ্ঞতার কথা।
আজ শনিবার রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে আয়োজিত এক সেমিনারে উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যবসার ক্ষেত্রে এসব অভিজ্ঞতার কথা জানান। চীনা দূতাবাস ও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
‘স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন উইথ চায়নিজ ইনভেস্টরস: চ্যালেঞ্জেস, এক্সপেকটেশনস অ্যান্ড প্রসপেক্টাস’ শিরোনামে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী। সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর সং ইয়াং, বিডার মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব, বেপজার নির্বাহী পরিচালক তানভীর হোসাইন, বিসিসিআইয়ের সভাপতি গাজী গোলাম মুর্তজা, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা প্রমুখ।
বিনিয়োগে বাধা কোথায় বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আকিজ গ্রুপের পরিচালক শেখ আমিন উদ্দিন বলেন, ১৩ বছর আগে টাঙ্গাইলে আকিজ সিএনজি প্ল্যান্ট স্থাপন করে সেখানে গ্যাস–সংযোগের জন্য তিতাস গ্যাসে আবেদন করেন। গ্যাস–সংযোগ পেতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। তবে এখনো গ্যাসের সংযোগ মেলেনি।
এ সময় বিডার মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব আকিজ গ্রুপের পরিচালকের উদ্দেশে বলেন, ‘কাল (রোববার) বিডা অফিসে আসেন। আপনার বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব।’ একই সময়ে তিতাস গ্যাসের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) স্বাগতম কুমার সাহা বলেন, বিনিয়োগের জন্য শিল্পে গ্যাস–সংযোগ পাওয়া জরুরি। কিন্তু গ্যাসের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ–সংকট রয়েছে। পেট্রোবাংলা সংকট দূর করতে এলএনজি আমদানি ও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের চেষ্টা করছে। শিল্পে অল্প সময়ের মধ্যে গ্যাস–সংযোগ শুরু করা সম্ভব হবে।
সেমিনারে একজন চীনা উদ্যোক্তা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে ই-ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট পেতে দেরি হয়। ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ প্রক্রিয়া সহজ করা যায় কি না। জবাবে বিডার মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, নিরাপত্তা অনাপত্তির জন্য আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ম্যানুয়ালি পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়। এ জন্য সময় বেশি লাগে।
বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে জমি ইজারা নিতে সমস্যা হওয়ার বিষয় তুলে ধরেন একজন চীনা উদ্যোক্তা। জবাবে বিডার মহাপরিচালক বলেন, ‘এই বিষয়ে কোনো সমাধান আমার কাছে নেই।’ তবে উদ্যোক্তাদের বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বেপজার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, বিসিকের শিল্পনগরী কিংবা হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ থেকে জমি কেনার পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া জমি ইজারা নিয়ে কোনো জটিলতা দেখা দিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভূমি আইন অনেক জটিল। ভূমি মন্ত্রণালয় এটি সহজ করতে কাজ করছে। বিসিসিআইয়ের সভাপতি গাজী গোলাম মুর্তজা বলেন, প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অনেক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা আসছে। তাঁদের মধ্যে অনেক হতাশা আছে। সহজভাবে তাঁদের সমস্যাগুলোর সমাধান দেওয়া গেলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়বে।
কাস্টমসে এলইডি টিভির এইচএস কোড নিয়ে জটিলতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তা সমাধানের বিষয়ে জানতে চান একজন উদ্যোক্তা। জবাবে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় জানার থাকলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) যাওয়ার আহ্বান জানান এনবিআরের কর্মকর্তা খন্দকার নজরুল হক।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিডার নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে জমি কেনা, ইজারা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংযোগ, কর, শুল্ক নিয়ে উদ্যোক্তাদের অনেক সমস্যা হতে পারে। সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা “আফটার কেয়ার” সার্ভিস চালু করেছি। আফটার কেয়ার চালুর পর বিএসআরএম, লাফার্জ সিমেন্টসহ বিভিন্ন কোম্পানির সমস্যা সমাধান করেছি।’
অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ আসবে। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ দরকার বলে জানান তিনি।
বিসিসিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে একক সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী ছিল। করোনা মহামারির কারণে চীনা বিনিয়োগ কম এসেছে। তবে এখন অনেক বিনিয়োগ আসছে। চীনা বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।