কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাত। টানা দুই অর্থবছর এই খাতের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলারের বেশি হয়েছে। তবে গত অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে ২৭ শতাংশ। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে চায়। জানুয়ারিতে নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ তিনটি খাতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার অনুসন্ধানে সহায়তা করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই খাতের রপ্তানি সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে সরকার নীতিগত সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে রপ্তানি বাড়াতে কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন?
আহসান খান চৌধুরী: বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের ব্যবসা এগিয়ে নিতে যা যা সহায়তা প্রয়োজন, তা ইতিমধ্যে আমরা পেয়েছি। আমার মনে হয়, ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয় ব্যবসা–বহির্ভূত ইস্যুতে। যেমন ধরুন, অমুক জায়গায় কিছু সন্ত্রাসী ব্যবসায়ীদের কষ্ট দিচ্ছে। সেই কষ্ট লাঘবে ব্যবসায়ীর দুইটি দিন চলে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উদ্যোক্তারা যদি স্বস্তিতে না থাকেন, তাহলে তাঁরা ব্যবসায়ে পূর্ণোদ৵মে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী যদি নিজের কার্যালয়ের একটি বিশেষায়িত মোবাইল ফোন নম্বর কিংবা ই-মেইল অ্যাড্রেস দেন, তাহলে সেখানে ব্যবসায়ীরা তাঁদের সমস্যার কথা জানাতে পারেন। ব্যবসায়ীরা অন্যায় আবদার করলে শোনার দরকার নেই। তবে ন্যায্য আবদার থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান দিতে হবে, এটা আশা করেন ব্যবসায়ীরা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু প্রচুর ই–মেইলের জবাব দেন। ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধান হলেই আমরা উত্তরোত্তর এগিয়ে যাব।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারকদের অনেকেই বলেন, শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পেলে তাঁদের সুবিধা হতো।
আহসান খান চৌধুরী: আমরা বিস্কুট রপ্তানি করি। এর জন্য কিছু উপকরণ আমদানি করি। আবার কিছু দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করা হয়। ধরুন, আমরা চকলেট রপ্তানি করতে চাচ্ছি। তবে আমাদের দেশে কোকোবীজ বা পাউডার উৎপাদন হয় না। সুইজারল্যান্ডেও কোকো পাউডার উৎপাদন হয় না। তবে উপকরণটি আমদানি করে চকলেট বানিয়ে তা রপ্তানি করে দেশটি। আমরা সেভাবে করতে চাই। আমাদের দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় উপকরণ আমদানিতে বন্ডেডওয়্যার–সুবিধা আছে। তবে বন্ডের মধ্যে কিছু কষ্টের নিয়ম আছে। শতভাগ রপ্তানিমুখী কারখানা না হলে বন্ড–সুবিধা পাওয়া যায় না। তবে আমাদের দেশে এমন কারখানাও তো আছে, যারা ১০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করে। আসলে আমাদের অধিকাংশ কারখানাই এমন। বড় কারখানার পক্ষে রপ্তানি ও দেশীয় সরবরাহের জন্য আলাদা কারখানা করা সম্ভব। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তাদের বেলায় সেটি করা খুবই কঠিন। বর্তমানে তাদের জন্য নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। এত দিন ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হলেও তা কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ধাপে ধাপে এটি কমানো হবে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর আর নগদ সহায়তা থাকবে না। এটা নিয়ে উদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তা করছেন না। তবে এখন থেকে যদি প্রস্তুতি গ্রহণ না করা হয়, তাহলে আগামী দিনে আমরা প্রতিযোগিতা–সক্ষমতা ধরে রাখতে পারব না। আমাদের নগদ সহায়তা দরকার নেই, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিন। প্রয়োজন হলে উপকরণ আমদানির নথিতে লিখে রাখেন যে এটুকু আমদানি করেছি এবং তার বিপরীতে কতটুকু রপ্তানি হবে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি যদি হিসাব দিতে পারি, তাহলে তো কারখানায় অভিযান চালানোর দরকার নেই।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে আমাদের কৃষি খাতে কী করতে হবে বলে আপনার মনে হয়?
আহসান খান চৌধুরী: আমাদের দেশের কৃষিতে প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। এখানে প্রযুক্তি মানে সরকার লাঙল কিনে দেবে, সেটি নয়। প্রযুক্তি মানে হচ্ছে, ফসলের জাত উন্নয়ন। ধরুন, একটি আমগাছ ২ ফুট বাই ২ ফুট জায়গা দখল করে। এখন ফলটা যদি পরিমিত না হয়, তাহলে সেই গাছ তুলে নতুন জাত লাগাতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রে উৎপাদন হচ্ছে বড় বিষয়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানা ব্যাপকভাবে গড়ে উঠবে। তার জন্য কয়েকটি ফসলকে আমাদের টার্গেট করতে হবে। চিনি আমদানির ওপর শুল্ক কমাতে হবে। না হলে বিভিন্ন ধরনের খাবার আমরা কম দামে ভোক্তাকে দিতে পারব না। রপ্তানিতেও পিছিয়ে পড়ব।
কোন কোন ফসল উৎপাদনে আমাদের জোর দিতে হবে?
আহসান খান চৌধুরী: বাংলাদেশ অনেক ছোট দেশ। সব ধরনের ফসল উৎপাদনে গেলে তেমন কিছুই হবে না। আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের হিসাবনিকাশ করে দেখা প্রয়োজন, আমরা কোন কোন ফসল উৎপাদনে জোর দেব। যেসব ফসল সস্তা, সেগুলো আমরা আমদানি করব। আর তুলনামূলক দামি ফসলটা আমরা চাষ করব। আমরা আমের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। টমেটো উৎপাদন বাড়িয়ে দাম কমানোর চেষ্টা চলছে। মসলা উৎপাদনের ওপর ব্যাপকভাবে মনোযোগ দিতে হবে। ইদানীং মুরগির বাচ্চা, মুরগি ও ডিমের দাম আমাদের ভোগাচ্ছে। এখানে পুলিশিং করলে কোনো সমাধান আসবে না। কী করলে উৎপাদন বাড়বে, তার ওপর জোর দিতে হবে আমাদের।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে রপ্তানির সম্ভাবনা কতটা বড়?
আহসান খান চৌধুরী: আমাদের জন্য সম্ভাবনা অসীম। আমরা এখনো সেই সম্ভাবনার ১ শতাংশেও যেতে পারিনি। আমাদের কোম্পানির রপ্তানি ৩০ কোটি ডলার। খুব সহজেই সেটিকে ৩০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সীমাবদ্ধতাও আছে। এ জন্য কাউকে আমরা দোষ দিই না। আমাদের ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। আমাদের ব্যাংক খাত ভালো না চললে আমি তো ঋণ পাব না।
আমাদের হিমায়িত খাদ্য, কনফেকশনারি ও মসলাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বড় সম্ভাবনা রয়েছে। জার্মানি থেকে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্কুট রপ্তানি হয়। তাহলে বাংলাদেশ থেকে কেন হবে না। বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এখানে মেধাবী মানুষের ঘাটতি নেই। সাময়িক কিছু সমস্যা থাকবেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমরা এখনো শিশু। তাই একে অপরকে দোষারোপ না করি। আমলাদের বলব, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। তাহলে দেশ উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে। আমাদের দুর্বলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। আমাদের দুর্বলতা সমাজেরই প্রতিফলন। যদি আমাদের কোনো দুর্বলতা আপনাদের কাছে প্রতিফলিত হয়, তাহলে গঠনমূলক সমালোচনা করে তা সংশোধনের সুযোগ দিন। তাহলেই দেখবেন সমস্যা থাকবে না।