চামড়া নিয়ে বসে আছেন আড়তদারেরা
চামড়া নিয়ে বসে আছেন আড়তদারেরা

এবার পাঁচ লাখ চামড়া নষ্ট হয়েছে, আগ্রহ নেই ছাগলের চামড়ায়

চলতি বছর কোরবানি ঈদের প্রথম দুই দিন সংরক্ষণের অভাবে সারা দেশে প্রায় পাঁচ লাখ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়েছে, যার বেশির ভাগই খাসি ও বকরির চামড়া। এ তথ্য জানিয়েছে ট্যানারিশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। সংগঠনটি বলছে, মূলত অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চামড়া ছাড়ানো এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এটা ঘটেছে।

আজ বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ঈদুল আজহা–পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বিটিএ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী ও বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ।

শাহীন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এবারও ছাগলের চামড়া কিনতে কেউ আগ্রহ দেখাননি। ফলে বিপুলসংখ্যক ছাগলের চামড়া নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া অদক্ষ লোক দিয়ে পশুর চামড়া ছাড়ানো এবং ঠিক সময়ে লবণ না দেওয়ায় কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচ লাখ হতে পারে।

ছাগলের চামড়া নষ্টের দুই কারণ

ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাতের পদ্ধতি কিছুটা আলাদা। ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে, এমন ৪০ থেকে ৫০টা ট্যানারি প্রতিষ্ঠান একসময় রাজধানীর হাজারীবাগে ছিল। ২০১৭ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরীতে ট্যানারি স্থানান্তর হয়। তবে ওই সময় ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী অধিকাংশ ট্যানারি সেখানে যায়নি। বর্তমানে চামড়াশিল্প নগরীতে এ ধরনের মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি ট্যানারি রয়েছে।

শাহীন আহমেদ জানান, অল্প কয়েকটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত পরিমাণ ছাগলের চামড়া কেনা ও প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয় না। ফলে বাজারে চাহিদা কম থাকায় এ ধরনের চামড়ার উপযুক্ত দাম পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে, ট্যানারিতে ছাগলের প্রতিটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে এক হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। তবে এই চামড়া বিক্রির সময় আবার ভালো দাম পাওয়া যায় না। এটিও ছাগলের চামড়া নষ্টের পেছনে আরেকটি কারণ বলে জানান বিটিএ সভাপতি। তিনি বলেন, ছাগলের চামড়া নষ্ট ঠেকাতে হলে এ জাতীয় ট্যানারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্যানারিগুলোকে অর্থায়নের মাধ্যমে পুনরায় চালুর সুযোগ দিতে পারে।

মোট ৯০ লাখ চামড়া সংগ্রহ

চলতি বছর কোরবানি ঈদের প্রথম দুই দিন সারা দেশে কাঁচা চামড়া লবণজাতসংক্রান্ত তথ্য সাংবাদিকদের জানান মো. শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, ঈদের পর সারা দেশে আনুমানিক ৯০ লাখ চামড়ায় লবণ যুক্ত করা হয়েছে। এই সংখ্যা গত বছরের কাছাকাছি। অর্থাৎ এবার চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় সেভাবে বাড়েনি।

শাহীন আহমেদ বলেন, এবারের ঈদ মৌসুমে রাজধানী ঢাকায় সব মিলিয়ে ১০ লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাভারে চামড়াশিল্প নগরীতে অবস্থিত ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ৪ লাখ ৭৫ হাজার চামড়া লবণজাত করেছে। বাকি চামড়া সংগ্রহ করেছেন পোস্তার আড়তদার, ব্যাপারী ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, শুরুতে রাজধানী ঢাকায় সংগৃহীত লবণযুক্ত চামড়াগুলো ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাত করা হবে। আর সাত দিন পর সারা দেশের বড় বড় হাট ও মোকাম থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা ও প্রক্রিয়াজাত শুরু করবে ট্যানারিগুলো।

ঈদুল আজহা–পরবর্তী চামড়া সংগ্রহের পরিস্থিতি জানাতে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)

কাঁচা চামড়ায়ও দাম নির্ধারণ হতে পারে

প্রতিবছর সরকার সাধারণত লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। চলতি বছর ঢাকার মধ্যে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। তবে ঈদের সময় মূলত চোখের আন্দাজে কাঁচা চামড়ার আয়তন হিসাব করে বেচাকেনা হয়। ফলে প্রতিবছরই চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ করেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে শাহীন আহমেদ বলেন, ‘লবণযুক্তের পাশাপাশি কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হলে ভালো হবে। এতে চামড়ার দাম নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা একটা ধারণা পাবেন। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরব।’

তবে লবণযুক্ত চামড়ার দর থেকে ২৫০–৩০০ টাকা (লবণ দেওয়া ও মজুরি খরচ) বাদ দিয়ে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা করলে উপযুক্ত দামই পাওয়া যায় বলে জানান বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ।

সিইটিপি কাঙ্ক্ষিত মানে যায়নি

গতকাল মঙ্গলবার সাভারের চামড়াশিল্প নগরী পরিদর্শন করে শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে চামড়াশিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত ও কার্যকর করা হয়েছে। তবে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদের দাবি, সিইটিপি এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছায়নি। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও মানসম্মত পর্যায়ে আনা যায়নি। সিইটিপির ওপর চাপ কমাতে ট্যানারিগুলো এ বছর রেশনিং (ভাগ করে) করে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করবে বলে জানান তিনি।

এদিকে রপ্তানি আয় বাড়াতে আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চামড়া প্রক্রিয়াজাতের কথা বলেন এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানের সিইটিপি করা এখন সময়ের দাবি।

অর্থায়ন নিয়ে অভিযোগ

বিটিএ সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, চলতি বছর ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র ৭৫ কোটি টাকার মতো নতুন ঋণ পেয়েছে। পুরো খাতের আকারের তুলনায় এই ঋণ খুবই অপ্রতুল। অর্থায়ন বেশি হলে ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে প্রভাব রাখতে পারত। তাতে কাঁচা চামড়ার দাম আরও বাড়ত।

শাহীন আহমেদ জানান, ২০১৭ সালের দিকে কোরবানির সময়ে ট্যানারিগুলোকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হতো। সে টাকা ধাপে ধাপে কমে গত বছর ২৭০ কোটি টাকায় নামে। তবে অনেক ট্যানারি গত বছরের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। গত বছর কিছু ট্যানারি মোট ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। সেই পরিমাণ টাকাই এ বছর ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।