বর্তমানে বৈশ্বিক তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশ হচ্ছে ম্যান মেড ফাইবার (এমএমএফ) বা কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি পণ্য। আগামী ২০৩০ সালে এমএমএফ পণ্য রপ্তানি মোট পোশাক রপ্তানির ৬০ শতাংশ ছাড়াবে। তবে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে এমএমএফের হিস্যা এখনো অনেক কম; মোট পোশাক রপ্তানির ৩০ শতাংশের কম। অর্থাৎ বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের (পিডব্লিউসি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। আগামী দশকের জন্য দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পথনকশা নিয়ে পিডব্লিউসি ও তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই গবেষণা করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটির খসড়া প্রকাশ করা হয়। এ সময় বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, সংগঠনটির ২০২৪-২৬ সাল মেয়াদি পর্ষদের নবনির্বাচিত সভাপতি এস এম মান্নান, পিডব্লিউসির পরিচালক অরিন্দম সাহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘দেশের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে ২০২৩ সালে যেসব বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, সেগুলো আমরা কাটিয়ে উঠেছি। ব্যবসা সহজীকরণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে অনেক নীতি সহজ করা হয়েছে। তবে আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো সহজ করা প্রয়োজন।’
ফারুক হাসান জানান, তৈরি পোশাক খাতের বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি পণ্য বহুমুখীকরণেও ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। দেশে পরিবেশবান্ধব দুই শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় তৈরির ফলে পণ্যের ক্রয়াদেশে অগ্রাধিকার পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ভালো দামও পাওয়া যাবে।
পিডব্লিউসির গবেষণায় মোট সাতটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়গুলো হচ্ছে পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণ, প্রযুক্তি উন্নয়ন, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, সার্কুলারিটি, সামাজিকভাবে টেকসই শিল্প, বৈশ্বিক অর্থায়ন প্রাপ্তি ও এমএসএমই খাতের জন্য আর্থিক সহায়তা।
কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার বাড়াতে হবে
গবেষণায় পিডব্লিউসি বলেছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানি বেড়ে ১ হাজার ১২১ বিলিয়ন বা ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়াবে। সেখানে কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি পণ্যের হিস্যা হবে ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু কৃত্রিম তন্তুর পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে (২০২২ সালের হিসাব) চীন, ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও ইতালি কৃত্রিম তন্তুর পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে মোট পোশাক রপ্তানির বিপরীতে এমএমএফে চীনের হিস্যা ৬২ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৫৬ শতাংশ, তুরস্কের ৪৮ শতাংশ ও ইতালির ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২৭ শতাংশ হচ্ছে কৃত্রিম তন্তুর পণ্য।
বৈশ্বিক রপ্তানি চাহিদা ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকেও কৃত্রিম তন্তুনির্ভর পোশাক তৈরিতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে বলে মনে করে পিডব্লিউসি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বাংলাদেশে আরও বেশি পরিমাণে বেশি মূল্য সংযোজন করে এমন এমএমএফ পোশাকের দিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় ইকোসিস্টেম তৈরি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যদিকে, তৈরি পোশাক খাতে স্বচ্ছতা, শনাক্তকরণ ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি এবং ঝুঁকি কমাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন জরুরি।
দক্ষতা উন্নয়নের পরামর্শ
পিডব্লিউসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের ধারাবাহিক দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বর্তমানে সুপারভাইজাররা কর্মীদের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ভবিষ্যতে কর্মীদেরই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য তাঁদের বহুমুখী দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন।
পিডব্লিউসি জানায়, বাংলাদেশে বছরে ৫ লাখ ৭৭ হাজার টন ঝুট উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ ঝুট স্থানীয়ভাবে রিসাইকেল করা হয়। রিসাইকেল পণ্য নিয়ে ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন নীতি নিয়েছে। এসব নীতির প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও পড়বে। এ জন্য রিসাইকেল শিল্পে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন মান সনদ অর্জন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের বিষয়গুলো এখনো কম গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানায় পিডব্লিউসি। সংস্থাটি বলেছে, উন্নত কর্মপরিবেশ তৈরিতে দেশ এগিয়েছে; এখন সামাজিকভাবে টেকসই শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
ব্যবসা সহজীকরণে বাধা অনেক
বাংলাদেশে ব্যবসা সহজীকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এখনো অনেক বাধা রয়েছে বলে মনে করে পিডব্লিউসি। সংস্থাটি বলছে, ব্যবসা সহজীকরণে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পেছনে। এ দেশে ব্যবসায়ের খরচ অনেক বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশে বন্ড বা পুঁজিবাজারের মতো বিনিয়োগ সংগ্রহের জায়গাতেও বড় দুর্বলতা রয়েছে। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বিষয়ে কম আগ্রহী।
অন্যদিকে সুতা প্রাপ্তিতে শতভাগ আমদানিনির্ভরতা, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে দীর্ঘ সময় লাগা, উচ্চ সুদহার, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি বিষয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।