জাপান ও ভারতীয় ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল এখন দেশে তৈরি হয়। রয়েছে দেশি ব্র্যান্ডও। তবে এখন খাতটি বিপাকে পড়েছে।
মোটরসাইকেলের সুপরিচিত জাপানি ব্র্যান্ড ইয়ামাহার মোটরসাইকেল এখন দেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে তৈরি কোনো মোটরসাইকেল বাজারে ছাড়ার আগে তা পরীক্ষা করেন ইয়ামাহার জাপানি কারিগরি কর্মকর্তারা। তাঁরা ছাড়পত্র দিলে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।
বাংলাদেশে ইয়ামাহার কারিগরি সহায়তায় মোটরসাইকেলের কারখানা করা এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে ইয়ামাহার কারখানায় যে মানে মোটরসাইকেল উৎপাদিত হয়, সমমান রক্ষা করেই বাংলাদেশে তৈরি হয়। না হলে বাংলাদেশে ইয়ামাহা নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে মোটরসাইকেল তৈরি করতে দিত না।
জাপানের ইয়ামাহা ছাড়াও হোন্ডা ও সুজুকি এবং ভারতের বাজাজ, টিভিএস, হিরোসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল এখন বাংলাদেশে তৈরি হয়। কোম্পানিগুলো বলছে, দেশের বাজারে বছরে প্রায় ৬ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়, যার ৯০ শতাংশই দেশে উৎপাদিত।
মোটরসাইকেলশিল্পের এই যাত্রা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে সরকারি নীতিসহায়তা পেয়ে। বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিমামা) তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশে মোটরসাইকেল কারখানা হয়েছে ১০টির মতো। বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষের। মোটরসাইকেল খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার।
দেশে মোটরসাইকেলের হাত ধরে অটোমোবাইল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে। অবশ্য যাত্রা শুরুর কয়েক বছরের মাথায় এসে হোঁচট খাচ্ছে মোটরসাইকেলশিল্প। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শিল্পকে দ্বিতীয় ধাপে নেওয়ার জন্য যে উদ্যোগ দরকার, সেখানে ভাটা চলছে। যন্ত্রাংশ ও উপকরণ তৈরির জন্য সহযোগী শিল্প বা ভেন্ডর গড়ে ওঠেনি। মোটরসাইকেলের বাজার আশা অনুযায়ী এগোয়নি, বরং চাহিদা কমে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতির ধারাবাহিকতার অভাব।
এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলছিলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় মোটরসাইকেলশিল্পকে এগিয়ে নিতে পরিকল্পনা ঠিক করে। অন্যরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়, যা শিল্পের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত।
বাংলাদেশে মোটরসাইকেলশিল্প
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৮৪ সালে দেশে প্রথম মোটরসাইকেল সংযোজন কারখানা হয়। তবে বিষয়টি আর আগায়নি। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ২০১৫ সালে মোটরসাইকেল কারখানা করার জন্য উপযোগী নীতিমালা করতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ২০১৮ সালে তৈরি হয় মোটরসাইকেলশিল্প উন্নয়ননীতি। এতে ২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বছরে ১০ লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়।
২০১৮ সালেই মূলত দেশে কারখানা করার কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু হয়। দেশের কারখানায় তৈরির কারণে মোটরসাইকেলের দাম কমে। বিক্রি বাড়ে। ২০১৫ সালে দুই লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছিল, যা ২০২২ সালে ছয় লাখে উন্নীত হয়।
বিক্রি কমেছে ৩৬%
কোম্পানিগুলোর হিসাবে, ২০২৩ সালের প্রথম পাঁচ মাসে মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ কম। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ কয়েকটি—১. মার্কিন ডলারের দামের কারণে মোটরসাইকেলের মূল্যবৃদ্ধি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া; ২. মোটরসাইকেল কিনতে হলে চালকের লাইসেন্স লাগবে, ৩০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চালানো যাবে না, মহাসড়কে চালানো যাবে না, এসব খসড়া নীতিমালার বিরূপ প্রভাব; ৩. ডলার-সংকটের কারণে আমদানিতে সমস্যা এবং ৪. দুর্ঘটনার ভয়ে অনেকে মোটরসাইকেল কিনতে চান না। বিমামার সভাপতি ও উত্তরা মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল ব্যবসা এখন ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে।
উদ্বেগ দুর্ঘটনা নিয়ে
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়ছে এবং নিহত ব্যক্তিদের ৩৫ শতাংশের মতো মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। কোম্পানিগুলো বলছে, ব্যয়সাশ্রয়ী ও স্বাচ্ছন্দ্যের বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়বেই। দুর্ঘটনা কমাতে দরকার সড়কে বিশৃঙ্খলা কমানো ও আইন মেনে চলতে বাধ্য করা।
বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেডের (বিএইচএল) প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) শাহ মোহাম্মদ আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাপান, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ দুর্ঘটনা কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশেও তেমন উদ্যোগ নেওয়া দরকার।