সারা বছরই চুইঝালের চাহিদা থাকে। তবে ঈদের মতো উৎসবে চুইঝালের চাহিদা বেশি। খুলনা ছাড়িয়ে চুইঝাল এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
অনেক দিন ধরেই খুলনা অঞ্চলের পরিবারগুলোর বাজারের ফর্দে চুইঝালের অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত। বিশেষ করে মাংস রান্নার কোনো আয়োজন থাকলে তো আর কথাই নেই; অবধারিতভাবে চুইঝাল লাগবেই। তবে মসলাজাতীয় এই পণ্য এখন আর দক্ষিণের আঞ্চলিক গণ্ডিতে আটকে নেই। গত কয়েক বছরে চুইঝালের বাজার রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য বলছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চুইঝাল উৎপাদন হয়েছে ৫৭৬ টন। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৩৪৭ টন চুইঝাল। এক অর্থবছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে ২২৯ টন।
পাঁচ বছর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে চুইঝালের মোট উৎপাদন ছিল ২৩৮ টন। অর্থাৎ চুইঝালের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষকেরাও বাণিজ্যিকভাবে এটি উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। বদৌলতে গত ছয় বছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি।
মানুষ একই ধরনের খাবার বারবার না খেয়ে ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্ন পদের খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাতে চুইঝালে রান্না করা মাংসের চাহিদা বাড়ছে, যা পাওয়া যেত না। অনেকে এ ধরনের খাবার বিক্রি করে ভালো ব্যবসা করছেন।মো. ওসমান গনি, সভাপতি, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি
ডিএইর তথ্যানুযায়ী, চুইঝাল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে খুলনা জেলা। গত অর্থবছরে এই জেলায় ২১৮ টন উৎপাদিত হয়েছে। পরের অবস্থানে আছে বাগেরহাট জেলা, যেখানে উৎপাদিত হয়েছে ২০০ টন। এ ছাড়া গত অর্থবছরে সাতক্ষীরায় ১২৬ টন ও নড়াইলে ৩২ টন চুইঝাল উৎপাদিত হয়েছে।
ডিএই সাতক্ষীরার উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অপ্রচলিত ফসল হওয়ায় আগে কৃষকের মধ্যে চুইঝাল উৎপাদনের আগ্রহ কম ছিল। এখন বাজারে চাহিদা এবং দাম ভালো থাকায় এটির বাণিজ্যিক চাষ বাড়ছে।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলের পাশাপাশি যশোর জেলাতেও চুইঝালের আবাদ হয়ে থাকে। আর এসব জেলার মানুষ আগে শখের বশে বসতবাড়ির আশপাশে চুইঝালের চাষ করতেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে খামার গড়ে তুলছেন। তাতে ডিইএর হিসাবের চেয়ে চুইঝালের বাজার আরও বেশ বড় বলেই ধারণা করা যায়। অনেকে নার্সারির মাধ্যমে চুইঝালের চারা উৎপাদন করে থাকেন।
খুলনার খর্ণিয়া এলাকার চুই নবদ্বীপের স্বত্বাধিকারী নবদ্বীপ মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছর চুইঝাল বিক্রি হয়। তবে ঈদের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে চুইঝালের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বাড়ে। কুরিয়ারের মাধ্যমেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চুইঝাল নিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, ‘তিন-চার বছর আগেও বছরে দুই থেকে তিন হাজার চুইঝালের চারা বিক্রি হতো। এখন বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো বিক্রি করতে পারি।’
বর্তমানে খুলনা অঞ্চলের পাইকারি বাজারে এক কেজি ভালো মানের চুইঝালের দাম ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর কম দামের যে চুইঝালের কেজি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা স্থানভেদে পাইকারির চেয়ে কেজিতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি রাখেন।
সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে প্রতি কেজির গড় দাম ১ হাজার ২০০ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশে চুইঝালের বাজারের আকার ৭০ কোটি টাকার। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাজারের প্রকৃত আকার শতকোটি টাকার বেশি হবে।
ডিএই খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মোহন কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশব্যাপী চাহিদা থাকায় চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে। উচ্চ মূল্যের ফসল হওয়ায় কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে উৎপাদন আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
চুইঝাল হচ্ছে একধরনের মসলা। এই গাছের তিনটি অংশই মসলা হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী। গাছের মাথার অংশটি সবচেয়ে মূল্যবান। দামে ও মানে এর পরের অবস্থান কাণ্ডের। তারপর ডালের অংশ। চুইঝাল ছোট টুকরা করে কেটে গরু, খাসি ও হাঁসের মাংস রান্না করা খুলনা অঞ্চলের ঐতিহ্য, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাজধানীতে চুইঝালের চাহিদা বেশ বাড়ছে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি মো. ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ একই ধরনের খাবার বারবার না খেয়ে ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্ন পদের খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাতে চুইঝালে রান্না করা মাংসের চাহিদা বাড়ছে, যা পাওয়া যেত না। অনেকে এ ধরনের খাবার বিক্রি করে ভালো ব্যবসা করছেন।