ঢাকার নবীনগর থেকে চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা
ঢাকার নবীনগর থেকে চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা

শ্রম অসন্তোষে আশুলিয়ায় আট পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

চলমান শ্রম আন্দোলনের কারণে সাভারের আশুলিয়ার আটটি তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তার মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার বন্ধ করা হয় ছয়টি। এ ছাড়া শ্রমিকেরা কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করায় এদিন ২১টি কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। ১৫-২০ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট ও নিম্নতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণসহ কয়েকটি দাবিতে শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন।

আশুলিয়ায় গত বুধবার পঞ্চম দিনের মতো এমন ঘটনা ঘটেছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ে গত সোমবার মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে পাঁচ ঘণ্টা দর–কষাকষির পর সরকারপক্ষের সমঝোতায় নিম্নতম মজুরি কাঠামো পুনর্নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট চূড়ান্ত হয়। তার আগের দিন আশুলিয়ার একাধিক কারখানায় শ্রমিকেরা ১৫-২০ শতাংশ ইনক্রিমেন্টসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেন। শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন এমন কারখানার সংখ্যা সোমবার থেকে বাড়তে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে গত বুধবার প্রথমে নাসা গ্রুপ তাদের কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।

জানা গেছে, আশুলিয়ার উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি শান্ত করতে সাভারের গলফ ক্লাবে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাবাহিনীর কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা। বৈঠকে সেনা কর্মকর্তারা জানান, কিছু শ্রমিকনেতা শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছেন, এমন তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। তখন শ্রমিকনেতারা জানান, যাঁরা বেআইনি কাজ করবে, তাঁদের সমর্থন দেওয়া হবে না। সভায় শ্রমিকদের সচেতন করে তোলার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা নিয়ে আলোচনা হয়।

আশুলিয়ার বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মী ও একাধিক কারখানার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকালও বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হয়ে কাজ না করে বসে থাকেন। অন্যদিকে কয়েকটি কারখানায় কাজ শুরু হলেও কিছুক্ষণ পরে শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দেন। পরে ছুটি দিয়ে দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের কর্মবিরতির পরিপ্রেক্ষিতে গত দুই দিনে আটটি কারখানা শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে। কারখানাগুলো হচ্ছে এজে সুপার গার্মেন্টস, মাম গার্মেন্টস, ফিরোজা গার্মেন্টস, নাসা সুপার গার্মেন্টস, নাসা বেসিকস, ট্রাউজার লাইন, আল-মুসলিম অ্যাপারেলস ও এস সুহি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক।

শ্রমিকেরা কাজ না করায় গতকাল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ১৩ কারখানায়। সেগুলো হচ্ছে নিট এশিয়া, নেক্সট কালেকশন, মুন রেডি ওয়্যার, স্টার্লিং ক্রিয়েশন, পাইওনিয়ার ক্যাজুয়াল ওয়্যার, ডেকো ডিজাইন, শারমিন অ্যাপারেলস, শারমিন ফ্যাশন, শারাফ অ্যাপারেলস, ইসায়াত অ্যাপারেলস, ইথিক্যাল গার্মেন্টস, ফ্যাশন ফোরাম ও জিহান গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ। এ ছাড়া শ্রমিকদের স্ববেতনে আগামী অ্যাপারেলস, ক্রস ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ, নিউ এইজ অ্যাপারেলসের নিট ও ওভেন ইউনিট, নিউএজ গার্মেন্টস, কাইলক নিউ এইজ, বান্দো ডিজাইন এবং মেডলার অ্যাপারেলস—এই আট কারখানায় উৎপাদন হয়নি কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউ এইজ গ্রুপের একটি কারখানার একজন নারী শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শনিবার থেকেই সমস্যা হচ্ছিল। ওই দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত কাজ করছিলাম। তার পরের দিনগুলোতে কারখানায় অল্প সময় কাজ হওয়ার পরে সবাই কর্মবিরতি শুরু করেন। তারপর কর্তৃপক্ষ ছুটি দিলে সবাই চলে যান। আজকে (গতকাল) মোবাইলে মেসেজ (খুদে বার্তা) পেয়েছি কারখানা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হইছে।’

বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে শ্রমিকদের প্রত্যাশা ছিল বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ বা তার বেশি হবে। যদিও আনুষ্ঠানিক দর–কষাকষিতে সেটি ৯ শতাংশ চূড়ান্ত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের সচেতন করার পাশাপাশি নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দ্রুত আসা প্রয়োজন
আমিরুল হক, সভাপতি, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন।  

জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রতিনিধিদের কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শ্রমিকদের থামিয়ে দেওয়া যাবে না। সমস্যা দেখতে হবে। সবাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলছেন। তবে কেউ মূল সমস্যা খুঁজে বের করছেন না। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধির দাবি যৌক্তিক। বছর শেষে ছুটির টাকা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। শ্রমিকেরা অনেকে বলেছেন, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ হলেও কিছুটা ভালো হতো। এ ছাড়া মজুরি পর্যালোচনার বিষয়ে সরকার কী করছে, সেটি শ্রমিকেরা জানেন না।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত আগস্টে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ওষুধশিল্পের শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভে নামেন। ওষুধ খাতের উদ্যোক্তারা নিজ নিজ কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে কিছু দাবি মেনে নেন। ফলে সে খাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কিন্তু পোশাকশিল্পে জটিলতা বাড়তে থাকে। এতে গাজীপুর ও আশুলিয়ায় অনেক কারখানার উৎপাদন দিনের পর দিন ব্যাহত হয়। শ্রমিক নিহতের ঘটনাও ঘটে। পরে ২৪ সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ও টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ ১৮ দফা মেনে নিতে সম্মত হয় মালিকপক্ষ। তারই অংশ হিসেবে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের এক মাসের বেশি সময়ের আলোচনার পর ইনক্রিমেন্ট অতিরিক্ত ৪ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।

জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে শ্রমিকদের প্রত্যাশা ছিল বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ বা তার বেশি হবে। যদিও আনুষ্ঠানিক দর–কষাকষিতে সেটি ৯ শতাংশ চূড়ান্ত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের সচেতন করার পাশাপাশি নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দ্রুত আসা প্রয়োজন। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য রেশনব্যবস্থা চালু করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।