দেশ স্বাধীনের পরের বছর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৩৪ কোটি ৮৪ ডলারের পণ্য। তারপর ৫০ বছরে রপ্তানি ১৪৯ গুণ বেড়েছে।
করোনার ধাক্কার পর দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায় দেশের পণ্য রপ্তানি খাত। মাঝের একটি বছর রপ্তানি আয়ের গ্রাফ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তখন ব্যবসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগও গতি পায়। করোনার ক্ষতটাও শুকিয়ে আসতে থাকে। আরও ভালো করার প্রত্যাশা নিয়ে নতুন বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল শুরু হয়।
কিন্তু দুই মাস না যেতেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া-ইউক্রেন। এই সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। কিছু নিত্যপণ্যের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতির খড়্গ নামে দেশে দেশে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দেন। তখন ক্রয়াদেশ আসার হারও কমে যায়। আবার দেশেও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট চরম আকার ধারণ করে। উৎপাদন ব্যাহত হয় মাসের পর মাস।
এমন সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিদায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি পাঁচ হাজার কোটি ডলার মাইলফলক অতিক্রম করেছে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, ৫ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৪২২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। সেই তুলনায় বিদায়ী বছরে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিকে বহুমুখী করার জন্য নগদ সহায়তা পুনর্গঠন করতে হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প যে পরিমাণ নগদ সহায়তা পায়, তা পুনর্গঠন করে অপ্রচলিত পোশাক রপ্তানিতেও তা দেওয়া যেতে পারে।।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
স্বাধীনতার পর রপ্তানি পণ্য বলতে ছিল শুধু পাট আর চামড়া। এই দুটি পণ্যে ভর করেই ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৩৪ কোটি ৮৪ ডলারের পণ্য। তখনকার দেশীয় মুদ্রায় যা ছিল ২৭১ কোটি টাকার মতো। তার মধ্যে পাট ও পাটপণ্যের অবদান ৮৯ দশমিক ৬৬ আর চামড়ার ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির শুরুর গল্পটা এমনই। তবে আশির দশকের গোড়ার দিকে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয় তৈরি পোশাক। ধীরে ধীরে খাতটির দাপট বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পাটকে হটিয়ে শীর্ষ স্থান জায়গা দখল করে নেয় তৈরি পোশাক। সঙ্গে নিত্যনতুন পণ্যও যুক্ত হতে থাকে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ৫০ বছরে পণ্য রপ্তানি ১৪৯ গুণ বেড়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৩১ হাজার ২১৬ টাকা (প্রতি ডলার ১০২ টাকা ধরে)।
গত অর্থবছরে তৈরি পোশাকের রপ্তানিই ছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। এভাবেই প্রায় তিন যুগ ধরে পণ্য রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। বর্তমানে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। যদিও ২০২০ সালে ভিয়েতনামের কাছে এই মুকুটটি হারায় বাংলাদেশ। এক বছরের ব্যবধানে সেটি আবার ফিরেও আসে। গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)।
২০২২ সালে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যা নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। ১২ মাসে ৩০টি তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানা পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে। তাতে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৭টিতে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক আর কোনো দেশে এত পরিবেশবান্ধব কারখানা নেই।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আকাশ যত বড়, তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনাও তত বড়। আমাদের তৈরি পোশাক খাত অনেক দিক দিয়ে প্রতিযোগী অধিকাংশ দেশের চেয়ে এগিয়ে গেছে। ফলে আমাদের বিকল্প নেই—এ কথা বললেও বাড়াবাড়ি হবে না।’
মোস্তাফিজ উদ্দিন আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মন্দার আশঙ্কায় বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের তেমন করণীয় নেই। তবে বসে থাকা যাবে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে যেসব ক্রয়াদেশ আসবে, সে অনুযায়ী যেন যথাসময়ে উৎপাদন করতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারের নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই রপ্তানি বাড়বে। কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মোদ্দাকথা, প্রতিযোগী দেশ যেন কোনো সুযোগ না পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
গত ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রথমবারের মতো বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির মাইলফলকে পৌঁছায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আবার পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বিলিয়ন ডলারে ওঠে। পরে আবার ধস নামে। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। একই সঙ্গে হোম টেক্সটাইলও এই চমক দেখায়। গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক ছাড়াও হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্য—এই পাঁচ খাতের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিকে বহুমুখী করার জন্য নগদ সহায়তা পুনর্গঠন করতে হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প যে পরিমাণ নগদ সহায়তা পায়, তা পুনর্গঠন করে অপ্রচলিত পোশাক রপ্তানিতেও তা দেওয়া যেতে পারে।
একই সঙ্গে পোশাকের বাইরে যেসব খাত ১০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি করছে, তাদের জন্যও নগদ সহায়তা বাড়ানো দরকার। উদীয়মান পণ্যেও প্রণোদনা দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত পণ্য—সব পর্যায়ে প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলেই পশ্চাৎমুখী সংযোগশিল্প শক্তিশালী হবে। নতুন নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হবে।