পোশাক কারখানা সংস্কার শেষ হয়নি ১০ বছরেও

ক্রেতাদের দুই জোট সংস্কারকাজ অনেকটা এগিয়ে নেওয়ার পর বাংলাদেশ ছাড়ে। তারপর সংস্কারের গতি কমে গেছে। 

রানা প্লাজা ধসে পড়লে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হন

রানা প্লাজা ধসের পর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এই কাজে ঢিলেমি শুরু হয়েছে ক্রেতাদের উদ্যোগে গঠিত দুই জোট বাংলাদেশ ছাড়ার পর। 

যেমন রানা প্লাজা ধসের পর ইউরোপীয় ক্রেতাদের উদ্যোগে গঠিত জোট অ্যাকর্ড ২০২০ সালের জুনে বাংলাদেশ ছাড়ে। তখন থেকে কারখানা পরিদর্শন ও সংস্কারকাজ তদারকি করছে দেশীয় উদ্যোগে গঠিত সংস্থা আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)। যদিও সংস্থাটি শুরু থেকেই ধীরগতিতে চলছে। বর্তমানে তাদের অধীন রয়েছে ১ হাজার ৮২৩ পোশাক কারখানা। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫০৪টি কারখানা সব ধরনের ত্রুটি সংশোধন সম্পন্ন করেছে।

দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা সাভারের রানা প্লাজা ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সেই ঘটনায় রানা প্লাজায় থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা যান। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন। ওই ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছিল। বিচারকাজও এখনো শেষ হয়নি।

অবশ্য রানা প্লাজা ধসের পর পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে জোর দিয়েছেন রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পমালিকেরা। পোশাক ও বস্ত্র খাতে এখন ১৯৫টি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে। ঠিকায় কাজ বা সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ে পোশাক তৈরির নীতিমালা করা হয়েছে। নতুন সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। অধিকাংশ কারখানায় সেফটি বা নিরাপত্তা কমিটি হয়েছে। শহরের ভাড়া ভবন থেকে অনেক কারখানা সরে গেছে। অন্যদিকে শ্রম অধিকার বিষয়ে শ্রম আইনে দুবার সংশোধনী এনেছে সরকার। 

সার্বিকভাবে পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানায় বড় কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শ্রমিকের কর্মপরিবেশ নিরাপদ করা ও পোশাক খাতের ভাবমূর্তির স্বার্থে সংস্কারকাজ শেষ করা দরকার। অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী কারখানাও তদারকির আওতায় এনে সংস্কার করতে হবে। যেসব কারখানা এখনো তদারকির বাইরে, সেখানে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকের প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এমন ঘটনা ভাবমূর্তি সংকটে ফেলবে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে। 

কারখানার সংস্কারকাজে ধীরগতি কেন জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানার নিরাপত্তাজনিত ত্রুটি সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। আরও করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারখানায় বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি আর নেই। কারখানার মালিকদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, ব্যবসা নয়, নিজেদের (শ্রমিক-মালিক) জন্য কর্মপরিবেশ নিরাপদ রাখতে হবে।’

তিন উদ্যোগের এখনকার হাল 

রানা প্লাজা ধসের পর ইউরোপীয় ক্রেতারা যেমন অ্যাকর্ড গঠন করেছিল, তেমনি উত্তর আমেরিকার ক্রেতারা গঠন করেছিল অ্যালায়েন্স নামের জোট। দেশীয় উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা (এনটিএপি)। তিনটি উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো বিস্তারিতভাবে নিরীক্ষা করে অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও ভবনের কাঠামোর দুর্বলতাজনিত ঝুঁকি চিহ্নিত করা ও তার সমাধান। 

অ্যাকর্ড গঠিত হয় ২০১৩ সালে পাঁচ বছরের জন্য। নানা টানাপোড়েন শেষে ২০২০ সালে আরএসসির কাছে কার্যক্রম হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ছাড়ে তারা। তখন অ্যাকর্ড জানিয়েছিল, তাদের অধীনে থাকা ১ হাজার ৬২৯ কারখানার সামগ্রিক সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে সাড়ে ৯২ শতাংশ। তবে বাকি ৮ শতাংশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংস্কারকাজ বাকি ছিল। যেমন তখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩৩৩ কারখানায় আগুন শনাক্ত ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা (ফায়ার অ্যালার্ম অ্যান্ড ডিটেকশন সিস্টেম) বসেনি।

অ্যাকর্ডের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর আরএসসি কী করেছে, তা দেখা যায় তাদের গত ফেব্রুয়ারির অগ্রগতি প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, এখন তাদের অধীনে থাকা ১ হাজার ৮২৩টি কারখানার মধ্যে ১ হাজার ৬৯২টির সামগ্রিক সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে ৯১ শতাংশ। সব ধরনের ত্রুটি সংশোধন করেছে ৫০৪টি কারখানা। বাকিদের ত্রুটি সংশোধনকাজ পুরোটা শেষ হয়নি। ১৩১টির প্রাথমিক পরিদর্শন হয়নি। 

জানতে চাইলে আরএসসির কো-চেয়ার শ্রমিকনেতা আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবিক অর্থে আরএসিসির গতি একটু শ্লথ। এটিকে আরও সচল করার চেষ্টা হচ্ছে। বর্তমানে কারখানা পরিদর্শন নিয়মিত পরিদর্শনকাজ চলছে। আরএসসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুতে মালিকপক্ষের কিছু হস্তক্ষেপ থাকলেও সেটি কাটিয়ে ওঠা গেছে। বর্তমানে স্বাধীনভাবেই কাজ করতে পারছে।

২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়। তখন তারা জানিয়েছিল, তাদের অধীনে থাকা কারখানাগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি সংস্কারকাজ শেষ করেছে তারা। অ্যালায়েন্স চলে যাওয়ার পর কারখানাগুলো তদারকিতে নিরাপন নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়েছিল। তবে সেটি এখন নেই। অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে নেওয়া পুরো সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে কি না, তা কেন্দ্রীয়ভাবে তদারকি করা হয় না। 

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দক্ষিণ এশিয়ার শ্রম বিশেষজ্ঞ সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেখা যায় দেশের পোশাক খাতে বিদেশিদের সরাসরি চাপ থাকলে কোনো কাজে অগ্রগতি হয়। আর যখন চাপ থাকে না, তখন কোনো কিছুকে বাধ্যতামূলক মনে করা হয় না। কারখানা সংস্কারের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। 

অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বাইরে (বিজেএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য) যেসব কারখানা ছিল, তা নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয় জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা বা এনটিএপির অধীনে। সরকার, মালিকপক্ষ ও আইএলও যৌথভাবে উদ্যোগটি নিয়েছিল। এর আওতায় ১ হাজার ৫৪৯টি কারখানা ছিল। এসব কারখানার পরিদর্শন ২০১৫ সালের নভেম্বরে শেষ হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এসব কারখানা একটি বড় অংশ শহরাঞ্চল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অথবা বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিদের সংস্কারকাজ শুরু থেকে ধীরগতিতে চলছিল। তাদের আওতায় এখন ৬৬৬ কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার সংস্কারকাজ শেষ হয়নি। 

এনটিএপির অধীনে পোশাক কারখানার নিরীক্ষা করা হয়েছিল সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি) নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী ছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। তারপর নতুন করে ‘ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিট’ গঠন করে সংস্কারকাজ শেষ করার চেষ্টা করছে ডিআইএফই। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিআইএফইর একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিটের অধীনে থাকা ৬৬৬টি কারখানার মধ্যে ৩৬টি এখন পর্যন্ত সব ধরনের ত্রুটি সংস্কারকাজ সম্পন্ন করেছে। সংস্কারকাজে উদ্যোগী না হওয়ায় গত এক বছরে ১০টি কারখানার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

পরিদর্শনের বাইরে কারখানা

আরএসসি এবং ইন্ডাস্ট্রি সেফটি ইউনিটের তদারকির বাইরেও পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয়। তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত, তা-ও অজানা। এসব কারখানা কোনো ধরনের পরিদর্শনের আওতায় আনা যায়নি।

অবশ্য আরএসসি সূত্রে জানা গেছে, ঠিকায় কাজ করা কারখানাগুলো পরিদর্শন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আরএসসির পরিচালনা পর্ষদ। তা ছাড়া ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে না, এমন কারখানাও পরিদর্শন করবে তারা।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বিগত ১০ বছরে কারখানার সংস্কারকাজে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা দিয়ে পোশাকশিল্প বেশি দূর যেতে পারবে না। এ জন্য সব কারখানার সংস্কার কার্যক্রম একটি সমন্বিত উদ্যোগের অধীনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। সেই উদ্যোগের কর্তৃপক্ষকে হতে হবে শক্তিশালী। তাদের কার্যক্রম হতে হবে স্বচ্ছ।