দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় কারখানাভেদে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।
মাসের পর মাস গ্যাস-সংকটে ভুগছে অধিকাংশ সিরামিক কারখানা। দিনের একটি বড় সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় কারখানাভেদে পণ্য উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত অব্যবহৃত থাকছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে ৩০-৪০ শতাংশ।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস-সংকটসহ নানা কারণে আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচ ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বাড়তি অর্থ দিচ্ছে না। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।ইরফান উদ্দিন, পরিচালক , ফার সিরামিক
সিরামিক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য উৎপাদনের ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সে অনুপাতে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম মিলছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় সব কারখানাকে। কিন্তু এভাবে মাসের পর মাস লোকসান গুনে ব্যবসায় টিকে থাকা যাবে না। তাঁরা জানান, সিরামিক কারখানায় সাধারণত তিন মাসের কাঁচামাল মজুত রাখা হয়। তবে ডলার-সংকটে বর্তমানে বেশ কিছু ব্যাংক কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলছে না। তাতে রপ্তানি নেই এমন প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে পড়েছে। দুই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কিছু কারখানা কাঁচামালের সংকটে পড়বে।
বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এই খাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে তৈজসপত্র উৎপাদনের ২০টি, টাইলসের ৩২টি ও স্যানিটারি পণ্যের ১৮টি কারখানা। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মূল্য সংযোজন ৬৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে সিরামিকশিল্পে ১৩ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। খাতটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন উদ্যোক্তারা। প্রায় সবাই নানাভাবে খরচ কমাচ্ছেন। শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ বা ওভারটাইম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।মঈনুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বিসিএমইএ
তৈজসপত্র উৎপাদনকারী ২০ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২৫ কোটি পিস। তারাই তৈজসপত্রের দেশীয় চাহিদার ৮৭ শতাংশ পূরণ করে। ৩২টি টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় চাহিদার ৮৬ শতাংশ জোগান দেয়। তাদের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ২১ কোটি বর্গমিটার টাইলস। স্যানিটারি পণ্যের দেশীয় চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
গ্রেটওয়াল সিরামিকের দুটি কারখানা আছে গাজীপুর ও হবিগঞ্জের মাধবপুরে। গ্যাস-সংকটের কারণে তাদের গাজীপুরের টাইলস কারখানার উৎপাদন ৬০ শতাংশ কমেছে। তবে মাধবপুরের কারখানায় গ্যাস নিয়ে সমস্যা না থাকায় পুরোদমেই স্যানিটারিওয়্যারের উৎপাদন চলছে।
এ সম্পর্কে গ্রেটওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গাজীপুরের কারখানায় মাসে ১ কোটি ২০ লাখ বর্গফুট টাইলস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমার গ্যাস পাচ্ছি। বাকি সময় গ্যাসের চাপ একেবারেই থাকছে না। দিনের বেলায় যে সাত ঘণ্টা গ্যাস থাকে তখন আমাদের পাঁচটি চুল্লির মধ্যে সর্বোচ্চ তিনটি চালাতে পারছি। তাতে সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এতে পণ্য উৎপাদনের খরচ ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে।’
গাজীপুরের ফার সিরামিকের দৈনিক ৬০ হাজার পিস তৈজসপত্র উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে ৬-৮ ঘণ্টার বেশি গ্যাসের চাপ থাকছে না। এ জন্য সক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি পণ্য করতে পারছে না তারা। আবার গত এক মাসে ৫০-৬০ লাখ টাকার পণ্য নষ্ট হয়েছে।
এ বিষয়ে ফার সিরামিকের পরিচালক ইরফান উদ্দিন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস-সংকটসহ নানা কারণে আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচ ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা বাড়তি অর্থ দিচ্ছে না। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে লোকসান গুনে দীর্ঘদিন কারখানা চালানো কোনোভাবেই সম্ভব না।’
সিরামিক খাতের প্রায় সব কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্লে বা কাদামাটি, যা প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৬০ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ লাখ ১৫ হাজার টন ক্লে আমদানি হয়। তার আগের বছর আমদানি হয়েছিল ৯ লাখ ৬৭ হাজার টন ক্লে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামালের দাম একদফা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আরেক দফা দাম বেড়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে বিসিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মুন্নু সিরামিকের ভাইস চেয়ারম্যান মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন উদ্যোক্তারা। প্রায় সবাই নানাভাবে খরচ কমাচ্ছেন। শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ বা ওভারটাইম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গ্যাস-সংকটের মধ্যে যেসব কারখানার ক্রয়াদেশ আছে, তারা সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে করে গ্যাস এনে হলেও উৎপাদন চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের পণ্য উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। তবে সে অনুযায়ী পণ্যের মূল্য বাড়েনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, আসছে ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’