বাড়ছে সুদের হার, চাপে ব্যবসায়ীরা

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আবারও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এতে ব্যাংকঋণের সুদহারও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সুদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য নয়—এমন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তাতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত তুলে রাখছেন অনেক উদ্যোক্তা। শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলের যৌক্তিকতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।

গত বছরের জুনেও ব্যাংকঋণের সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ। বর্তমানে সেটি বাড়তে বাড়তে ১৪-১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি সপ্তাহে আরেক দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এতে আরেক দফা ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়তে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।

গাজীপুরের টঙ্গীর মাজুখান এলাকার এক্সক্লুসিভ ক্যান নামক কারখানা রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধের বোতল তৈরি করে। গত মাসে প্রতিষ্ঠানটির একটি কারখানার ঋণের সুদ বাবদ সাড়ে ১৩ শতাংশ হারে ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। ৯ শতাংশ সুদহারে আগে এই কিস্তির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের ব্যয় বেড়েছে ৫৯ লাখ টাকা।

এক্সক্লুসিভ ক্যানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমরা এক দফা মূলধন হারিয়েছি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে সুদহার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সব মিলিয়ে ব্যবসায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।’

তিন যুগ ধরে স্যানিটারি, প্লাস্টিকের দরজা, আসবাব ও গৃহস্থালি পণ্যের ব্যবসা করছে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপ। শিল্পগোষ্ঠীটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পণ্যের চাহিদা এরই মধ্যে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমাতে বাধ্য হয়েছি। তবে স্থায়ী খরচ কমানোর কোনো সুযোগ নেই। ফলে প্রতি ইউনিট পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সেটি আরও বাড়বে।’

যখন মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল, তখন ওষুধ দেওয়া যায়নি। সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ না দেওয়ায় বহুমুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে। শুধু সুদের হার বাড়ালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

রিয়াদ মাহমুদ আরও বলেন, বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দফায় দফায় সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ভালো কোম্পানিও চাপে পড়ে যাবে। অনেকে রুগ্‌ণ হয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের নীতি সহায়তা দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২০২০ সালের এপ্রিলে সরকারের পরামর্শে ব্যাংকঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে মেয়াদি আমানতের সুদহারও বেঁধে দেওয়া হয়, সে হার ছিল ৬ শতাংশ। এরপর দীর্ঘদিন ব্যাংক খাতে ঋণ ও আমানতের ক্ষেত্রে সুদহার ৯-৬-এ সীমাবদ্ধ ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতি নানা সংকটে পড়লে গত বছরের জুলাইয়ে সুদের হার বাড়তে শুরু করে।

গত আগস্টে আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরই অংশ হিসেবে গত দুই মাসে দুই দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়ানোর ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ওভারনাইট রেপো সুদহার ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। ফলে ঋণসহ সব ধরনের ব্যাংকিং পণ্যের সুদের হার বাড়বে। বাজারে অর্থের সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের গত তিন মাসে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে ঋণের কিস্তিই দেওয়া হবে। মূল টাকা আর পরিশোধ হবে না। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে শুধু ঋণখেলাপিই বাড়বে। নতুন করে কর্মসংস্থান হবে না।

উচ্চ সুদহারসহ সার্বিক পরিস্থিতির কারণে আমরা আপাতত তৈরি পোশাক কারখানায় বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুদের হার বাড়লে নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
শামস মাহমুদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শাশা ডেনিমস

তৈরি পোশাকশিল্পের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে তাদের সক্ষমতার তুলনায় ৬০-৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আছে—এমন তথ্য দিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই লোকসান দিয়ে চলছে। তীব্র গ্যাস–সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নতুন করে সুদহার বাড়লে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের লোকসান বাড়বে।

দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বিদায়ী ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে চলতি বছরও বিনিয়োগে সুখবর মিলছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এমনকি এই সময়ে প্রাথমিক কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শাশা ডেনিমস তাদের ৪৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আপাতত স্থগিত করেছে। তৈরি পোশাক কারখানা ও ডেনিম কাপড় উৎপাদন সক্ষমতার বাড়াতে ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছিল প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তারা শুধু ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডেনিম কারখানার সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্চ সুদহারসহ সার্বিক পরিস্থিতির কারণে আমরা আপাতত তৈরি পোশাক কারখানায় বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুদের হার বাড়লে নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলো মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। তার জন্য অর্থায়ন দরকার। সুদহার বেশি থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানই ঋণ নেবে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল, ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বর তা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, যখন মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল, তখন ওষুধ দেওয়া যায়নি। সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ না দেওয়ায় বহুমুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে। পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি আছে কি না, এনবিআর নিত্যপণ্যে শুল্ক-করে পর্যাপ্ত ছাড় দিচ্ছে কি না, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে কি না—এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। তা না করে শুধু সুদের হার বাড়ালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কোনো দিশা না পেলে ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে যাবেন। এখন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছয় মাসের পরিকল্পনা জানালে ব্যবসায়ীরা আস্থা পাবেন।