চট্টগ্রাম বন্দর

জাহাজ কম, জেটি ফাঁকা

পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ আসার সংখ্যাও কমে গেছে। তাতে বন্দরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর
ছবি: প্রথম আলো

জাহাজ ভেড়ানোর জেটি ফাঁকা পড়ে আছে। শ্রমিকের হাঁকডাকও কম। পণ্য ওঠানো-নামানোর যন্ত্রের সাড়াশব্দও তেমন নেই। গত কয়েক দিন ধরে এই চিত্র বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান দ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে। অথচ মাসখানেক আগেও জাহাজ ভেড়ানোর জন্য জেটি বরাদ্দ পেতে শিপিং ব্যবসায়ীরা বন্দরে দৌড়ঝাঁপ করতেন।

জেটি ফাঁকা থাকার অর্থ হলো দেশে আমদানি কম হচ্ছে। এ কারণে বন্দরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও কমছে। বন্দরে কর্মরত শ্রমিকেরাও আগের মতো কাজ পাচ্ছে না। বেসরকারি ডিপোশিল্প, শিপিং লাইনস, জেটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন খাতের আয় কমে যাচ্ছে। পণ্য খালাসের সঙ্গে যুক্ত কাস্টমস এজেন্টদেরও আয় কমছে। কমছে সরকারের রাজস্বও।

বন্দর কর্মকর্তারা জানান, গত ডিসেম্বরে ১০ দিন চট্টগ্রাম বন্দরে দুই থেকে তিনটি করে জেটি খালি ছিল। নতুন বছরের প্রথম দিন চারটি, দ্বিতীয় দিন ছয়টি এবং তৃতীয় দিন আটটি জেটিতে কোনো জাহাজ ছিল না। অর্থাৎ ডিসেম্বরে পণ্য আমদানি কমার যে প্রবণতা ছিল, সেটি নতুন বছরে আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।

পণ্য আমদানি যে কমবে, তা অনুমিত ছিল আগেই। কারণ, ডলারসংকটে ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলতে পারছিলেন না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসপণ্য ও জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। তাতে গত অক্টোবর থেকে ঋণপত্র খোলা কমতে শুরু করে। আর তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বন্দরের কর্মকাণ্ডে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ধারাবাহিকভাবে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে। অক্টোবরে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়। নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ৪০২ কোটি ডলারে। সাধারণত ঋণপত্র খোলার পর এক থেকে দুই মাসে সেই পণ্য আমদানি শুরু হয়। অক্টোবরে ঋণপত্র খোলার হার কমে আসার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ডিসেম্বর থেকে। 

আমদানির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ৭১ লাখ টন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৮৬ লাখ টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে আমদানি আরও কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বছরের শুরুর কয়েক দিনের বন্দর কার্যক্রম দেখে এ ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা।

বন্দরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে ভাটা

আমদানি কমায় চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের সংখ্যাও কমছে। জাহাজের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে শিপিং এজেন্ট। এমনই দুটি প্রতিষ্ঠান কসকোল ও ইনস্কেপ শিপিং লাইনস লিমিটেডের চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা যেসব জাহাজের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন সেগুলোতে করে চীন থেকে প্রকল্প ও শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি আমদানি হতো। আগে প্রতি মাসে দুই প্রতিষ্ঠানের আওতায় ছয়টি জাহাজ আসত বন্দরে। এখন আসছে একটি।

বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজ থাকলে শ্রমিকদের কাজ থাকে। জাহাজ আসা কমে যাওয়ায় শ্রমিকেরা বেশির ভাগ সময়ই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। তাই আপৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সব জেটিতে সমানভাবে জাহাজ বরাদ্দের দাবি জানান তিনি।

বন্দরে আসা পণ্যের বড় অংশই প্রতিদিন স্থানান্তর হয় সাগরে। বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে স্থানান্তর করে এসব পণ্য নদীপথে দেশের নানাস্থানে নেওয়া হয়। এ কাজে জড়িত ৩২টি শিপ হ্যান্ডেলিং অপারেটরে কর্মরত রয়েছে দুই হাজার শ্রমিক। জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডেলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম শামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিনটি জাহাজের পণ্য খালাসের কাজ পেত। এখন একটির মতো জাহাজের পণ্য খালাসের কাজ পাচ্ছে। এতে শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা কমে গেছে।

পণ্য আমদানি কমার প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতেও। বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন বন্দর থেকে গড়ে সাত হাজার ট্রাক পণ্য পরিবহন করে। এই সংখ্যা এখন কমছে। পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত অন্তত ৩০ শতাংশ গাড়ি অলস বসে আছে। শ্রমিকেরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছে।

একই অবস্থা লাইটার জাহাজ পরিচালনা ব্যবসায়ও।  লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, একেকটি জাহাজ প্রতি দুই মাসে একবার বন্দর থেকে নদীপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছে। আগে মাসে দুবার পণ্য পরিবহন করতে পারত এসব জাহাজ।    

বন্দরে কনটেইনারের পণ্য ব্যবস্থাপনা করে বেসরকারি ডিপো। রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনার ৯০ শতাংশই হয় ডিপোতে।

আবার কনটেইনারে আমদানি করা পণ্যের এক চতুর্থাংশ বন্দর থেকে সরাসরি ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে এই খাতে। শ্রমিক-কর্মী রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার। পণ্য আমদানি কমে আসায় চট্টগ্রামে লাইসেন্স পাওয়া ২০টি ডিপোতেও কর্মকাণ্ড কমেছে। তাই এই শিল্পও এখন টিকে থাকার লড়াই করছে।

বেসরকারি ডিপো সমিতির সভাপতি নুরুল কাইয়ূম খান বলেন, রপ্তানি আয় বাড়লেও কনটেইনারের সংখ্যা বাড়েনি। আবার আমদানিও কমছে। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন কমতে থাকায় ডিপোর ব্যবসায় মন্দা চলছে। তবে তিনি আশা করছেন, কয়েক মাসের মধ্যে এই মন্দা কেটে যাবে।