র‍্যাপিডের আলোচনায় বক্তারা

শুধু এলডিসি উত্তরণের কারণে ওষুধের দাম বাড়বে না

শুধু স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের কারণে দেশে ওষুধের দাম তেমন একটা বাড়বে না। তবে ওষুধশিল্পে যেসব কাঠামোগত সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান না হলে এ খাতে সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুতের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে দেশের ওষুধশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে। এ বাস্তবতায় বিদ্যুতের দাম কমানোসহ সামগ্রিকভাবে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নের কথা বলেছেন ওষুধ খাতের উদ্যোক্তারা।

আজ শনিবার দ্য ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট অব এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন অন বাংলাদেশস ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ইটস ইমপ্লিকেশনস ফর ড্রাগ প্রাইসেস ইন দ্য লোকাল মার্কেট বা ‘বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে এলডিসি উত্তরণের প্রভাব ও স্থানীয় বাজারে ওষুধের দাম’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড) রাজধানীর একটি হোটেলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে মূল বক্তব্য দেন র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে ইয়াসির সিদ্দিকী।

র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক ওষুধশিল্পে এলডিসি উত্তরণের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ায় ওষুধের জন্য মেধাস্বত্ব মিলছে না। এ ছাড়া ২০২৩ সালে দেশে যে পেটেন্ট আইন হয়েছে, তাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সব সুযোগ-সুবিধা ধরে রাখা হয়েছে। ফলে উত্তরণের পর মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে যে উদ্বেগ ছিল, তা আমরা তা নিরসন করতে পেরেছি। ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কী করা যাবে, তা এই আইনে বলে দেওয়া হয়েছে।’

দেশে বিদ্যুতের দাম এখন উন্নত অনেক দেশের চেয়ে বেশি। গ্যাসের দামও বেড়েছে।

গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ায় দেশের ওষুধশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৫৬টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে।

গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তা নেই।

সহজে ব্যবসা করার সূচকে আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন।

কোন পরিস্থিতিতে কী হতে পারে, তার একটি প্রক্ষেপণ দিয়েছে র‍্যাপিড। এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘যেসব ওষুধ বাংলাদেশে তৈরি হয় না, সেগুলো আমদানির সঙ্গে এলডিসিতে উত্তরণের সম্পর্ক নেই। যেসব ওষুধগুলোর মেধাস্বত্ব এখনো আছে এবং আমরাও উৎপাদন করছি, সেগুলোর ক্ষেত্রেও ডব্লিউটিওর বিধান অনুসারে বাংলাদেশ মেধাস্বত্ব দিতে বাধ্য নয়। পেটেন্ট আইনেও বিষয়টি সেভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অর্থাৎ সেগুলো নিয়েও আমাদের চিন্তা করতে হবে না।’

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর যেসব ওষুধ পেটেন্টের আওতায় আসবে, সেগুলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে কী করতে হবে, তা পেটেন্ট আইনে উল্লেখ আছে। তাতে বলা হয়েছে, ওই সব ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলে ডব্লিউটিওর আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে ৪ শতাংশ লয়্যালটি দিতে হবে। এদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, সে ক্ষেত্রেও দেশের বাজারে ওষুধের দাম ২ থেকে ৪ শতাংশ বাড়বে।

এম এ রাজ্জাকের বক্তব্য অনুযায়ী মোদ্দাকথা হলো, শুধু এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবন কম। তবে অন্যান্য কারণে, যেমন ওষুধ তৈরির অন্যতম কাঁচামাল অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টের (এপিআই) দাম বাড়লে ওষুধের দামও বাড়তে পারে।

তবে এখন রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে ওষুধ খাতে যে ভর্তুকি পায় এলডিসি উত্তরণের পর তা দেওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন এম এ রাজ্জাক। বলেন, ইতিমধ্যে ভর্তুকি কিছুটা কমানো হয়েছে। এতে কিছুটা চাপ পড়তে পারে। দেশে এপিআই শিল্পপার্ক আছে, যদিও তা পুরোপুরি কার্যক্রমে আসেনি। শিল্পপার্কগুলো পুরোপুরি কার্যক্রমে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এম এ রাজ্জাক।

জ্বালানির দাম নিয়ে উদ্বেগ

সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই নিচের সারিতে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের উচ্চ দাম মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন অনুষ্ঠানে এ খাতের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, দেশে বিদ্যুতের দাম এখন অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বেশি। গ্যাসের দামও বেড়েছে। গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তা–ও নেই। সেই সঙ্গে এলডিসি থেকে উত্তরণের আগে পর্যন্ত নীতিগত যে সুবিধা আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন। এসব কারণে দেশের ওষুধ খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের ওষুধ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে উল্লেখ করেন কেউ কেউ।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যেকোনো কোনো ওষুধ কারখানায় একই সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুৎ তিনটি উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে এলএনজির দাম বাড়তি, ডিজেলের দাম আরও বেশি। সে জন্য খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত হলো, সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে, যাতে অন্তত দিনে কয়েক ঘণ্টা বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘খাতসংশ্লিষ্ট মানুষের কথা শুনে মনে হচ্ছে, অনেক মান–অভিমান আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে এখন বিভিন্ন খাতে সংস্কার হচ্ছে। সেই ধারায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সংস্কার হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী পরিবেশ নির্মাণে জোর দেওয়া হবে।

অনুষ্ঠানের প্যানেল আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) সায়েমা হক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এত কম বরাদ্দ নিয়ে স্বাস্থ্য খাত চলতে পারে না। এ ছাড়া ওষুধ খাতে গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দেন তিনি। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে নতুন ধাঁচের ওষুধ তৈরির পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় বাবদ খরচ অনেক বেশি হয়। এর মূল কারণ হলো, এই খাতে বাজেট বরাদ্দ বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে কম তাদের মধ্যে অন্যতম। র‍্যাপিডের সুপারিশ, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে দরিদ্র ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষুদ্র স্বাস্থ্যবিমা প্রবর্তন করা।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৫৬টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ওষুধ রপ্তানি করেছে। গত কয়েক বছরে অবশ্য ওষুধ খাতে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন র‍্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ, ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মো. আখতার হোসেন প্রমুখ।