দেশে এখন ছাপাখানা আছে সাড়ে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে বড় এক হাজার, মাঝারি দুই হাজার ও ক্ষুদ্র কারখানা আড়াই হাজার।
সর্বোচ্চ তিন হাজার মুদ্রণ কারখানা রয়েছে ঢাকায়।
বাজারের বার্ষিক আকার দেড় হাজার কোটি টাকা।
রপ্তানি হয় মোট ১৫০ কোটি টাকার পণ্য।
প্রত্যক্ষভাবে দেড় লাখ ও পরোক্ষভাবে তিন লাখ মানুষ যুক্ত।
নির্বাচনী প্রচারে কাগজের পোস্টার, লিফলেট ও কার্ডের সঙ্গে ডিজিটাল ব্যানার-ফেস্টুনের ব্যাপক চাহিদা থাকে। সব প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা একসঙ্গে শুরু হয় বলে সেই চাহিদার চাপ সামলাতে ছাপাখানা ও আনুষঙ্গিক পণ্যের ব্যবসায়ীদের তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে হয়। তবে এবারে নির্বাচনী প্রচার ব্যয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে যাবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) তাদের সমমনা অনেক দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও নির্বাচন উন্মুক্ত রেখেছে। এই সুযোগে মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের অনেকেই ভোট দাঁড়িয়েছেন।
কাগজ, কালিসহ আনুষঙ্গিক উপকরণগুলোর দাম বাড়তি থাকায় এবার প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারের ব্যয় বাড়বে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটসহ ৩০টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ৩০০ আসনে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ২০১৮ সালে, মানে গত সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ৩ হাজার ৬৫ জন। তখন যাচাই-বাছাই ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর চূড়ান্ত প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৪৮ জন। সেবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ৩৯টি রাজনৈতিক দল।
এবারে প্রতিটি আসনে গড়ে ৯ জনের বেশি প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাতে আশা করা যায়, ভোটের মাঠ সরগরম থাকবে। সব দল অংশ নিলে অবশ্য নির্বাচন উৎসবের আমেজ পেত এবং প্রচার-প্রচারণাও বেশি জমত। এখন দল ও প্রার্থী কমবেশি যা-ই হোক, মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে পোস্টার, লিফলেট, কার্ড ও ব্যানার-ফেস্টুনের চাহিদা মেটানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। যদিও তাঁদের অনেকেই ভালো ব্যবসা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।
সরেজমিনে গিয়ে আলাপকালে সম্প্রতি রাজধানীর নয়াবাজার, ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিল ও পুরানা পল্টন এলাকার মুদ্রণ ও এ-সংক্রান্ত উপকরণের ব্যবসায়ীরা জানান, নতুন বছর সামনে রেখে নভেম্বর-ডিসেম্বর এমনিতেই বই, ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি ছাপানোর একটা চাপ থাকে। এবারে এ রকম সময়েই নির্বাচন পড়ায় তাঁদের বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকার কথা জানান বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত। আলাপকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ছাপার ব্যবসা ভালো হয়। যেহেতু বড় একটি দল নির্বাচনে আসেনি, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা অর্ধেক হবে না। ছোট দলগুলো তো খুব বেশি পোস্টার ছাপায় না। এবার আবার উপকরণের দাম বেশি। এরপরও নির্বাচন উপলক্ষে ছাপাখানাগুলো কিছুটা প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশা করি।’
ব্যবসায়ীরা জানান, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি প্রার্থী ঘোষণা করায় ছাপাখানাগুলো এরই মধ্যে কাজের অর্ডার বা ফরমাশ পেতে শুরু করেছে। যদিও এখন অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েই পোস্টার-ব্যানার বেশি ছাপানো হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণার মূল কাজ পাওয়া নিয়ে ছোট ব্যবসায়ীরা একধরনের শঙ্কায় আছেন। কারণ, যাঁরা প্রচুর পরিমাণে ছাপাবেন, তাঁতের বড় প্রেসগুলোতে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।
রাজধানীর নয়াবাজারের মতিন স্টিকার হাউসের স্বত্বাধিকারী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভালো ব্যবসা করতে পারেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রার্থীর জন্য যেসব কার্ড-পোস্টার দিয়ে থাকেন, ওই কাজগুলো আমরা বেশি পাই।’
যেহেতু বড় একটি দল নির্বাচনে আসেনি, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা অর্ধেক হবে না। ছোট দলগুলো খুব বেশি পোস্টার ছাপায় না। এবার আবার উপকরণের দাম বেশি। এরপরও নির্বাচন উপলক্ষে ছাপাখানাগুলো কিছুটা প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশা করি।শহীদ সেরনিয়াবাত, সভাপতি, বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি
মুদ্রণকাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় এক বছরের বেশি সময় ধরে দফায় দফায় কাগজের কাঁচামাল, কালিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্যের দাম বেড়েছে। তাতে এবারে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণাকেন্দ্রিক ব্যয় বাড়বে। বর্তমানে পাইকারিতে হোয়াইট ও নিউজ প্রিন্ট কাগজের মানভেদে টনপ্রতি দাম এখন ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজা টাকার মধ্যে। অথচ এক বছর আগেও এর অর্ধেকের মতো ছিল দাম। অর্থাৎ তখন প্রতি টন তখন ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।
ফকিরাপুলের শিকদার প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী মো. নাসির উদ্দিন মনে করেন, প্রার্থী কম থাকার প্রভাব পড়বে ছাপার ব্যবসায়ে।
ডিজিটাল মেশিনে বড় ব্যানার ও ফেস্টুন তৈরির কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানেও বাড়তি খরচ গুনতে হবে। নকশা ও রঙের ওপর নির্ভর করে প্রতি ফুট ডিজিটাল ব্যানার ও ফেস্টুনের দাম পড়বে ১৫ থেকে ২৫ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১০ থেকে ২০ টাকা।
আরামবাগের হক প্রিন্টার্সের কর্মকর্তা তুষার আহমেদ বলেন, পিভিসি (প্লাস্টিক পোস্টারের কাগজ) ও কালির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ডিজাইন বা নকশা করার মজুরিও বেশি বেড়েছে। তবে দাম বাড়তি পড়লেও দ্রুত সরবরাহ করা যায় এবং টেকসই হওয়ায় এ ধরনের ব্যানার-ফেস্টুনের চাহিদা ভালো থাকবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার মুদ্রণ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বড় এক হাজার, মাঝারি দুই হাজার ও ক্ষুদ্র কারখানা আড়াই হাজার। সর্বোচ্চ তিন হাজার মুদ্রণ কারখানা রয়েছে ঢাকায়। এসব কারখানা রাজধানীর আরামবাগ, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, কাঁটাবন, নীলক্ষেতসহ পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, বাবুবাজার, বাংলাবাজার, ইসলামপুর, লালবাগ প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে।
বিসিকের তথ্যানুযায়ী, সার্বিকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ মুদ্রণ কারখানাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা। তাই কারখানাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে এক জায়গায় নিয়ে যেতে ২০১৬ সালে মুদ্রণশিল্প পার্ক গড়ে তোলার প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। এ জন্য মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বড়বত্তার এলাকায় ৪৩ একর জায়গা নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখনো শেষ হয়নি।
মুদ্রণশিল্পে উৎপাদিত পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বই, সাময়িকী, পত্রিকা, প্যাড, খাতা, স্টিকার, লিফলেট, ডায়েরি, ভিউ কার্ড, ভিজিটিং কার্ড, কার্টন ইত্যাদি। এই শিল্পে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বার্ষিক আর্থিক মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকা। রপ্তানি হয় ১৫০ কোটি টাকার পণ্য। মুদ্রণশিল্পে প্রত্যক্ষভাবে দেড় লাখ ও পরোক্ষভাবে প্রায় তিন লাখ মানুষ যুক্ত।