বিদায়ী অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছে ৭৯ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ কম।
ডলার–সংকটে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খান আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। এতে শিল্পের কাঁচামাল ও বিলাস পণ্যের মতো কিছু পণ্য আমদানিও কমে গেছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের আমদানির পরিসংখ্যানে সেই চিত্র উঠে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পণ্য আমদানি ব্যয় আগের অর্থবছরের চেয়ে কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। আর আমদানি হওয়া পণ্যের পরিমাণ কমেছে ৪ শতাংশের কাছাকাছি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এরপর গত বছরের জুলাই থেকে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার প্রভাবও পড়েছে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে।
পণ্য আমদানি বাড়লে সাধারণত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লে তাতে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উৎপাদনের ওপর ভর করে বাড়ে কর্মসংস্থান ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি। আবার রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লে রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভোগ্যপণ্য ও শিল্পপণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট ও সি কম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। সাময়িক স্বস্তি মিললেও দীর্ঘ মেয়াদে আমদানি কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ডলার-সংকটের সময়ে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখা উচিত।
কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনগুলোর আমদানির তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ কোটি ৩১ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১৩ কোটি ৮২ লাখ টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি পণ্যের পরিমাণ কমেছে ৫১ লাখ টন বা ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।
তবে খরচের হিসাবে আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলারের। শুল্কায়ন মূল্য ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। তবে ঋণপত্রের মূল্য হিসাব করা হলে খরচের কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। আমদানির এই হিসাব দেশের ৩৯টি কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনের। এসব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে ৯৫ শতাংশের বেশি পণ্য আমদানি হয়।
পরিমাণে কম-বেশি হলেও পণ্য আমদানি কমার তালিকাটি এবার বেশ বড়। এই তালিকায় যেমন রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল, তেমনি রয়েছে বিলাস পণ্য ও বাণিজ্যিক পণ্য। যেমন রড তৈরির প্রধান দুটি কাঁচামাল পুরোনো জাহাজ ও পুরোনো লোহার কথা ধরা যাক।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে পুরোনো লোহার টুকরার আমদানি ব্যয় কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি হয়েছে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ২৭৩ কোটি ডলারের। আমদানি কমার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় এবার বেশি কমেছে। একইভাবে পুরোনো জাহাজের আমদানি অর্ধেকে নেমেছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে ৫৩ কোটি ডলারের পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১১০ কোটি ডলার।
প্লাস্টিক শিল্পের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানিও কমেছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে প্লাস্টিক শিল্পের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানি হয় ২৩৪ কোটি ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ২৭৩ কোটি ডলারের। আমদানি ব্যয় কমার পাশাপাশি এ পণ্যের আমদানির পরিমাণও কমেছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আমদানি হয় ১৩ লাখ ৭৮ হাজার টন, আগের অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৩৫ হাজার টন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গম, চিনি, সয়াবিন তেল ও সয়াবিন তৈরির কাঁচামাল সয়াবিন বীজের আমদানিও কমে গেছে গত অর্থবছরে। তবে পাম তেলের আমদানি বেড়েছে। বিলাস পণ্য ফল ও বাদামের আমদানিও কমেছে এবার। যেমন ফলমূল ও বাদামজাতীয় পণ্য এবার আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৯৮ হাজার টন, যা গত বছরের তুলনায় ২ লাখ টন কম।
এ ছাড়া কমেছে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিও। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৯৮ কোটি ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ৩১৩ কোটি ডলার। সেই হিসাবে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে।
বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল তুলা আমদানি কমেছে গত অর্থবছরে। অবশ্য আমদানি কমলেও আমদানি ব্যয় প্রত্যাশিত মাত্রায় কমেনি। যেমন সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে তুলা আমদানি প্রায় ১৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ২৪ হাজার টন। তবে আমদানি ব্যয় কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৪১৫ কোটি ডলার।
গত অর্থবছরে আমদানি বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে কয়লা। এ সময়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় মূলত কয়লার আমদানি বেড়েছে। যেমন ৩৯টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬১ লাখ ৮২ হাজার টন কয়লা আমদানি হয়েছিল। এসব কয়লার আমদানি ব্যয় ছিল প্রায় ৫৪ কোটি ডলার। আর সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের ৯৩ লাখ ৬১ হাজার টন কয়লা আমদানি হয়েছে। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের হিসাব যুক্ত হলে কয়লা আমদানি লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
আবার সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লেও বিশ্ববাজারে দাম কমায় আমদানি খরচ কমেছে। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিঙ্কার আমদানি হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ টন। তাতে খরচ হয় ১১৮ কোটি ডলার। সেখানে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে ক্লিঙ্কার আমদানি হয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ টন। আর খরচ হয়েছে ১১৫ কোটি ডলার।
আমদানি ব্যয়ের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি যে কমেছে তা উৎপাদন ও ভোগের নেতিবাচক প্রভাব দেখে বোঝা যায়। ডলার–সংকটের কারণে এটা প্রত্যাশিত ছিল।
বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হয়েছে। তাই রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। আমদানিনির্ভর নয় এমন বৈদেশিক ঋণ যেগুলো পাইপলাইনে আছে, তা দ্রুত ছাড় করাতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়বে। আর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার সুযোগ কাজে লাগিয়ে উৎপাদনমুখী শিল্পে ব্যবহৃত পণ্যের আমদানি বাড়াতে হবে। তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে যাওয়া সম্ভব হবে।