রড–সিমেন্টের দাম 

বিশ্ববাজারে সুসংবাদ, দেশে দুঃসংবাদ

বিশ্ববাজারে নির্মাণ উপকরণ তৈরির কাঁচামালের দাম গত মে-জুনের তুলনায় কম। কমেছে জাহাজভাড়াও। পণ্যের দাম ও পরিবহনভাড়া কমে আসা সুখবরই বটে। তবে এই সুখবর দেশের ভোক্তা পর্যন্ত যাচ্ছে না। কারণ, ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি আর গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটে নির্মাণ উপকরণের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে দেশে। তাতে বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রভাব দেশের মানুষ পাচ্ছে না। সামনে নির্মাণ উপকরণের দাম যে কমবে, সে সম্ভাবনাও খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। 

আবাসন খাতের প্রধান নির্মাণ উপকরণ রডের কথাই ধরা যাক। এ বছরের জুনে রডের কাঁচামালের আমদানিমূল্য ছিল টনপ্রতি ৫৯১ মার্কিন ডলার। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববাজারে এ দাম কমেছে। গত নভেম্বরে টনপ্রতি ১২২ ডলার কমে রডের কাঁচামালের আমদানিমূল্য নেমে আসে ৪৬৯ ডলারে। 

বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে খুচরা বাজারে উল্টো বেড়েছে রডের দাম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, জুনে ঢাকার খুচরা বাজারে রডের দাম ছিল টনপ্রতি ৮৩ থেকে ৮৯ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে সাড়ে ৮৫ থেকে সাড়ে ৯৩ হাজার টাকা হয়েছে।

দাম বাড়ার জন্য দুটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছেন উদ্যোক্তারা। প্রথমত, ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ায় টাকায় আমদানি খরচ সামান্য বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটে কারখানা সক্ষমতা অনুযায়ী চালানো যায়নি, তাতেও বেড়েছে উৎপাদন খরচ।

গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, মাসখানেক আগে রডের কাঁচামালের দাম কমলেও ঋণপত্র খুলতে না পারায় সে সুযোগ নিতে পারেননি বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। সামনে যদি চাহিদা অনুযায়ী আমদানির ঋণপত্র খোলা না যায় তাহলে কাঁচামালের সংকট দেখা দেবে। গ্যাসের চাপ কম, বিদ্যুতের রেশনিং এখনো আছে। সামনে কোনো সুখবর নেই।

ঋণপত্র খুলতে কেমন অবস্থা, তা জানা যাক। ঢাকার একটি কারখানা মাত্র ৫০০ টন কাঁচামাল আমদানির জন্য চুক্তি করে একটি ইউরোপিয়ান সরবরাহকারীর সঙ্গে। দিনটি ছিল ২৮ অক্টোবর। এরপর ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। ১ মাস ১০ দিন পর ৮ ডিসেম্বর ২ লাখ ৩৫ হাজার ডলারের ঋণপত্র খুলতে পেরেছে ওই প্রতিষ্ঠান। 

শুধু রডের ক্ষেত্রেই নয়, সিমেন্টেও একই অবস্থা। কোম্পানিভেদে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল হলো ক্লিংকার। জুনের তুলনায় ক্লিংকারের আমদানিমূল্য কমেছে টনপ্রতি ১০ থেকে ১১ ডলার। তবে দেশে ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় উল্টো আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। আবার কারখানা পুরোদমে চালু রাখতে না পারায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। 

ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হলেও অর্থবছরের পাঁচ মাস পর্যন্ত রড ও সিমেন্টের কাঁচামালের আমদানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি রয়েছে। কাঁচামালে এই প্রবৃদ্ধি আগামী দিনে থাকবে না বলেই জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। 

কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম নিয়ে অস্থিরতা নেই। দাম এখন স্থিতিশীল। তবে প্রধান সমস্যা কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে না পারা। অর্থ্যাৎ কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে দাম স্থিতিশীল থাকবে। 

ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণ শুরুর আগে মানুষ প্রথমেই রডের দাম নিয়ে ভাবেন। বছরে রডের বাজারের আকার প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার। রডের দাম সহনীয় না হলে যেসব নির্মাণকাজ জরুরি নয়, তা পিছিয়ে দেন গ্রাহকেরা। দাম কমলে কাজে হাত দেওয়া যাবে—এমন চিন্তাভাবনা থেকেই নির্মাণকাজ শুরু হবে কি না, তা নির্ভর করে। রডের দাম নিয়ে আগামী দিনেও কোনো সুখবর মিলছে না। 

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইএমআর মেটালার্জিক্যাল রিসোর্সেস কোম্পানির বাংলাদেশের ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহমেদ বলেন, বিশ্ববাজারে পুরোনো লোহার টুকরার দাম এ বছর অক্টোবরে সর্বনিম্ম পর্যায়ে নেমেছিল। এই সুযোগ নিয়েছেন ভারতের উদ্যোক্তারা। কম দামে তাঁরা বিপুল পরিমাণ ঋণপত্র খুলেছেন। ঋণপত্র খুলতে না পারায় বাংলাদেশ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। এখন লোহার টুকরার দাম আবার টনপ্রতি ৫০ ডলার বেড়ে গেছে। ঋণপত্র খোলা যদি না যায় তাহলে কম দামে আমদানির সুফল মিলবে না। বরং বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে সামনে কাঁচামাল আমদানি কমে উল্টো সংকট তৈরি হতে পারে।