বছরে ফ্রিজের মোট বিক্রির ৬০-৭০ শতাংশ হয় পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায়।
রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের বাজারে এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশীয় কোম্পানির দাপট। বর্তমানে সারা বছর যে পরিমাণ ফ্রিজ বিক্রি হয়, তার প্রায় অধিকাংশই দেশে উৎপাদিত। বাকিটা আমদানি করা। তবে গত বছর ডলার-সংকটে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে না পারায় সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বাড়ায় ভুগেছে দেশি-বিদেশি সব কোম্পানি। তার সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি যুক্ত হওয়ায় বিক্রি কমে যায় ১২-১৫ শতাংশ।
অবশ্য সংকটের পর চলতি বছর আবার ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখছে ফ্রিজ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারের সংকট ও ঋণপত্র খোলার জটিলতা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে ফ্রিজের বিক্রিও বাড়তে শুরু করেছে। তবে সারা বছর যে পরিমাণ ফ্রিজ বিক্রি হয় তার ৬০-৭০ শতাংশ পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় হয়ে থাকে। চলতি বছর শেষে ফ্রিজ বিক্রিতে গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
ফ্রিজের দাম দেশের কম আয়ের মানুষের হাতের নাগালে আনতে দেশীয় কোম্পানিগুলোর ভূমিকা অগ্রগণ্য। ২০১০ সালের পর ফ্রিজের বাজার পুরো বদল গেছে। প্রথমে শুরুটা করে ওয়ালটন। তারপর ধীরে ধীরে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী কোম্পানির সংখ্যা বাড়তে থাকে। সরকারও নীতিসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। তখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিশ্বখ্যাত একাধিক ব্র্যান্ড দেশে ফ্রিজ উৎপাদন বা সংযোজনের উদ্যোগ নেয়। ফলে ধীরে ধীরে ফ্রিজে আমদানিনির্ভরতা কমে আসে।
দেশের ফ্রিজের বাজার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তিন বছর আগে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ ফ্রিজের বাজারের আকার ছিল প্রায় ৬৮ কোটি মার্কিন ডলারের। পরের বছর সেটি বেড়ে ৮৮ কোটি ডলারে দাঁড়াবে বলে ওই গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্তাব্যক্তি জানান, দেশের ফ্রিজের বাজার বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। বিক্রি কিছুটা কমে যাওয়ায় গত বছর সারা দেশে ১৭-১৮ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে।
ফ্রিজের বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ওয়ালটন। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ওয়ালটন ইলেকট্রনিকস যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালের শেষ দিকে তারা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা গড়ে তোলে। সেই কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে।
ওয়ালটনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) দিদারুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর কিছুটা সংকট ছিল। আশা করছি চলতি বছর ফ্রিজ বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে।’
আড়াই দশক ধরে দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায় আছে ইলেকট্রো মার্ট। ২০১৮ সালে তারা ঢাকার সোনারগাঁওয়ে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করে। সেখানে তারা কনকার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ফ্রিজ উৎপাদন করে।
দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম আরএফএল গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আরএফএল ইলেকট্রনিকস লিমিটেডও দেশে ফ্রিজ উৎপাদন করে। তাদের ব্র্যান্ডের নাম ভিশন।
অবশ্য আরএফএল গ্রুপের নিজেদের রপ্তানি আয় থাকায় ডলার-সংকটে খুব বেশি ভুগতে হয়নি বলে জানালেন আরএফএল ইলেকট্রনিকসের নির্বাহী পরিচালক নুর আলম। তিনি বলেন, ‘কাঁচামালের সরবরাহ চাহিদা অনুযায়ী থাকায় গত বছর আমাদের ফ্রিজ বিক্রি ৪০ শতাংশ বেড়েছে।’
২০২২ সালে দেশে ফ্রিজ সংযোজনের কাজ শুরু করে স্মার্ট টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সনি-স্মার্ট। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার জাহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্রিজের বাজারে আমাদের পদচারণ অল্প সময়ের হলেও ভালো সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি এ বছর ফ্রিজের বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।’
বিদেশি ব্র্যান্ড ইলেক্ট্রো ও স্যামসাং ফ্রিজের বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইলেক্ট্রো ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যাশা, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ফ্রিজের বিক্রি ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
ইলেক্ট্রো ইন্টারন্যাশনালের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) মো. মোবারক হোসেন বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালে উৎপাদন ব্যয় ২৫ শতাংশ বেড়েছিল। তবে বাজার ধরে রাখতে পণ্যের দাম ওই হারে বাড়ানো হয়নি।
বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ওয়ার্লপুলের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে নরসিংদীতে ২০২২ ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে ট্রান্সকম গ্রুপ। সেখানে ওয়ার্লপুলের পাশাপাশি ট্রান্সটেক ব্র্যান্ডের ফ্রিজ তৈরি হচ্ছে। অবশ্য এই দুটি ব্র্যান্ড ছাড়া হিটাচি, স্যামসাং, হায়ার ও প্যানাসনিক ব্র্যান্ডের ফ্রিজও বিক্রি হয় ট্রান্সকম ডিজিটালের বিক্রয়কেন্দ্রে।
ট্রান্সকম ডিজিটালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মাহবুব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের সংকট পুরোপুরি কাটেনি। তারপরও উৎসব কেন্দ্র করে বিক্রি বাড়ছে।
ফ্রিজের বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম যমুনা ইলেকট্রনিকস। ২০১৪ সাল থেকে যমুনা ব্র্যান্ড নামে ফ্রিজ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। যমুনা গ্রুপের পরিচালক মনিকা নাজনীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের নীতিসহায়তা পেলে ইলেকট্রনিক হোম অ্যাপ্লায়েন্স বড় রপ্তানি খাত হয়ে উঠবে।’