ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের (এসএমই) জন্য তারল্যের প্রবাহ না বাড়ালে অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁদের অর্থায়নে ব্যাংকের পাশাপাশি ইকুইটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে অর্থায়নের সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন।
আজ শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই কার্যালয়ে এসএমই নীতি নিয়ে আয়োজিত এক ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় এসব কথা বলেন আশরাফ আহমেদ। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনে ২০১৯ সালের এসএমই নীতির সংস্কার বিষয়ে এ আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
নারী উদ্যোক্তারা এসএমই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েন উল্লেখ করে আশরাফ আহমেদ বলেন, বেশির ভাগ নারীরই ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধক দেওয়ার মতো সম্পদ থাকে না। প্রয়োজনীয় দলিলপত্র বা নথির ক্ষেত্রেও তাঁরা সমস্যায় পড়েন। এসব কারণে তাঁরা ঋণ নেওয়ার সুযোগ পান না। নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়াতে তাঁদের জন্য ঋণ পাওয়ার সহজ ও ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সিএমএসএমই ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ কোটি টাকা নির্ধারণের পরামর্শ দেন ডিসিসিআই সভাপতি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সলিম উল্ল্যাহ বলেন, ২০১৯ সালের এসএমই নীতির মেয়াদ চলতি বছরের মধ্য জুনে শেষ হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ এই নীতি যুগোপযোগী ও বৈশ্বিক চাহিদা অনুসারে হালনাগাদ করা হবে। সে জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পাশাপাশি অংশীদারদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
সভায় বক্তারা বলেন, ২০১৯ সালের এসএমই নীতি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাব ছিল। সে জন্য নীতি বাস্তবায়নে ধীরগতি ছিল বা অনেক নীতি বাস্তবায়িত হয়নি। সময়–নির্ধারিত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি; এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পাওয়া যায়নি।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, এসএমই খাতে মূল্য সংযোজন কম হলেও দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে এ খাতের অবদান অনেক। তবে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ এসএমই এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে; তাদের আনুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত করা গেলে অর্থনীতির আকার বাড়বে।
কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির কথা চিন্তা করে এসএমইকে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা নিতে পারিনি; বরং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ–পরবর্তী চ্যালেঞ্জসহ বেশ কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।’
আশরাফ আহমেদ আরও বলেন, এসএমই নীতিতে কটেজ, অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞায়নে সমস্যা আছে। নতুন নীতিতে প্রতিটি গোষ্ঠীর আলাদা ও পরিষ্কার সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি, শিল্পনীতিসহ সব ক্ষেত্রে একই সংজ্ঞা অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এসএমইগুলোর জন্য চমৎকার নীতি প্রণয়ন করা হলেও সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। সময়-নির্ধারিত কর্মসূচিতে অসামঞ্জস্য আছে। যেমন এসএমই নীতিতে নতুন বাজার বৃদ্ধি ও রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিসিক ও এসএমই ফাউন্ডেশনকে; অথচ সেখানে ইপিবিকে যুক্ত করা হয়নি। এসএমইর পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রেও কিছু মান তৈরি করা প্রয়োজন। তাতে পণ্যের মান ও দক্ষতা বাড়বে, বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ও স্পেশাল প্রোগ্রাম বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তফা বলেন, এসএমইগুলোর জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার স্থাপন করে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন বাড়ানো দরকার।
এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক নাজিম হাসান বলেন, এসএমই নীতি ও কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হলেও সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সরকারের তরফ থেকে করা হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে বারবার বলা হলেও অর্থায়ন পাওয়া যায়নি।
নাজিম হাসান আরও বলেন, এসএমই নীতি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। কে কোন কাজ করে, তা অন্য প্রতিষ্ঠান জানে না। একই কথা বলেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পরিচালক কাজী মাহবুবুর রশিদ। তাঁরা এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিককে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, নতুন নীতিতে কে (সংস্থা) কোন কাজ করবে, তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইয়াকুব হোসেন বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে এমএফআই প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ভূমিকা রাখছে। অথচ এসএমই নীতির কোথাও তারা নেই।
এসএমইতে খেলাপি ঋণের হার কমানো গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ প্রদানে আরও আগ্রহী হবে বলে মনে করেন লংকাবাংলা ফিন্যান্সের সিএমএসএমই ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বিভাগের এমার্জিং ও মিডিয়াম বিজনেসের প্রধান খন্দকার মোস্তাক হোসেন।
ঢাকা ব্যাংকের এমএসএমই ও ইমার্জিং বিজনেস বিভাগের প্রধান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এসএমইগুলোর জন্য বেশ কয়েকটি রিফিন্যান্সিং স্কিম আছে; ব্যাংকগুলো টাকা নিয়ে বসে আছে, কিন্তু উপযুক্ত গ্রাহক (উদ্যোক্তা) পাওয়া যায় না।
এসএমই খাতে ট্রেডিং ব্যবসা বড় অবদান রাখছে, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অনেক। কিন্তু এসএমই নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ট্রেডিংকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ফিন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কায়সার হামিদ। সব অংশীজনকে নিয়ে এসএমই ইনোভেশন ল্যাব করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন।