সরকারি সংস্থা

বিপুল লোকসান জ্বালানি ও খাদ্যে, লাভ টোল আদায়ে

বাজেট ২০২৩–২৪
বাজেট ২০২৩–২৪

বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। একইভাবে বেশি দামে জ্বালানি তেল কিনে কম দামে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বেশি দামে খাদ্য কিনে কম দামে বিক্রি করেছে। ফলে এই তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাই চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ লোকসান করেছে, যার পরিমাণ ১৯ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এতে রাষ্ট্র খাতের সংস্থাগুলো সার্বিকভাবে লোকসানে চলে গেছে।

দেশে সেবা ও বাণিজ্যিক খাতে ৪৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রয়েছে। এর আগে সবশেষ ১০ বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো একইভাবে বড় লোকসানে পড়েছিল। এরপর ধারাবাহিক নিট মুনাফা করেছিল সংস্থাগুলো। গত বৃহস্পতিবার বাজেটের সঙ্গে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে।

আবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সেতুর টোল আদায় করে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছে ২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। এরপর বন্দর পরিচালনা করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) মুনাফা করেছে ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

সমীক্ষা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের গত ২৩ মে পর্যন্ত হিসাবে সংস্থাগুলো মিলে সার্বিক লোকসান করেছে ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট মুনাফা ছিল ১ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে মুনাফা ছিল ১৫ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা।

এর আগে সবশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব সংস্থার লোকসান হয় ২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। তখনো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কারণে এই লোকসান হয় বলে দেখানো হয়েছিল। নতুন করে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে টিসিবি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাত দুই বছর ছাড়া প্রতিবছরই লোকসান করছে। আর বিপিসি মাঝে সাত বছরই ভালো পরিমাণ মুনাফা করেছে।

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব সংস্থা ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছিল ১ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সার্বিকভাবে লোকসান করলেও ৯৮৩ কোটি টাকা সরকারকে লভ্যাংশ দেয় তারা।

মুনাফা থেকে লোকসানে
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করলেও চলতি অর্থবছর ৮৪ কোটি টাকা লোকসান করে। আর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গত অর্থবছরে ৮৫৪ কোটি টাকা মুনাফা করলেও চলতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ লোকসান করে, যার পরিমাণ ৫ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।

টিসিবির এই লোকসান শুরু হয় চলতি অর্থবছরে। গত আগস্টে দেশের এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি। এর ফলে বেশি দামে পণ্য কিনে কম দামে বিক্রি করতে হয় এই বিপণন সংস্থাকে।

টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আগে শুধু রমজান মাসে ট্রাকের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হতো। চলতি অর্থবছরে এক কোটি পরিবারের মাঝে স্বল্প মূল্যে খাদ্য বিক্রি শুরু হয়। এসব পণ্য কিনতে যা খরচ হয়, তার তুলনায় অনেক সময় তা প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করা হয়। এর ফলে লোকসান অনেক বেড়েছে। এটা মূলত সরকারি ভর্তুকি।

লোকসান থেকে মুনাফায়
এদিকে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান করলেও চলতি অর্থবছরে ৫৫ কোটি টাকা মুনাফা করে। বিএসইসি বর্তমানে ৯টি কারখানা চালায়। এর মধ্যে ৫টি লোকসানে ও ৪টি মুনাফায় আছে। এ ছাড়া বিএসইসির ৩টি কারখানা যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়। করপোরেশনটির আরও অন্তত ৬টি কারখানা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) গত অর্থবছরে ৪৬৩ কোটি টাকা লোকসান করলেও চলতি অর্থবছরে ৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করে। বিসিআইসির হাতে এখন কারখানা রয়েছে ১৯টি, এর মধ্যে ৯টিই বন্ধ। চালু থাকা ১০টি কারখানার মধ্যে সার উৎপাদিত হয় ৬টিতে। ৪টিতে কাগজ, সিমেন্ট, কাচ, স্যানিটারি ওয়্যার ও ইনস্যুলেটর উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) গত অর্থবছরে ২৫০ কোটি টাকা লোকসান করলেও চলতি অর্থবছরে ১০২ কোটি টাকা মুনাফা করে। বিআরইবি পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে।

লোকসানি তিন সংস্থা
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) চলতি অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা লোকসান করে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তাদের লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা, তবে এর আগের দুই অর্থবছরে মুনাফায় ছিল সংস্থাটি।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) চলতি অর্থবছরে ৭ হাজার ৮৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে বলে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান করেছিল ১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এর আগে সাত বছর তারা মুনাফায় ছিল।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো বছরের পর বছর যেভাবে চলছে, তাতে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় এসব সরকারি সংস্থাকে নানা মডেল অনুসরণ করে মুনাফায় নেওয়া হয়েছে। এ জন্য বেসরকারিকরণ, সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানাসহ নানা মডেল চালু হয়েছে। তবে এখানে সব সরকারের সময় একটি পক্ষ এসব সংস্থায় খবরদারি করে সুবিধা নেয়, ফলে সরকারগুলোও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমি মনে করি বিপিসির একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ করে বেসরকারি খাতকেও সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। লোকসানে থাকা সংস্থায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।’