তিন দশক আগেও সারা দেশের ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জে কার্যালয় খুলে ব্যবসা করেন। ঢাকার শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদেরও কার্যালয় ছিল এখানে। মাত্র দুই দশক পেরিয়ে এখন খাতুনগঞ্জে এমন হাঁকডাক নেই। সে সময়ের বড় গ্রুপগুলোর অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছে। এবারের আয়োজন দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ নিয়ে।
গত শতকের শেষ কিংবা একবিংশ শতকের শুরুর সময়। ভোজ্যতেলের বাজারে চট্টগ্রামের টি কে, আবুল খায়ের, এমইবি, মোস্তফা, এসএ, এনজিএসের মতো ১২টি গ্রুপের তুমুল প্রতিযোগিতা। খাতুনগঞ্জে সকাল শুরু হতো এসব প্রতিষ্ঠানের সয়াবিন-পামতেল বিক্রির কাগজ বা ডিও (চাহিদাপত্র) হাতবদলে। সড়কে-দোকানের সামনে থাকত ব্রোকারদের জটলা। শেয়ারবাজারের মতো অস্থিরতা, উত্তেজনা, দরপতন, ঊর্ধ্বগতি—এসব অনুষঙ্গের কোনো কমতি ছিল না। সয়াবিন ও পামতেলের মতো সরগরম ছিল চিনি, গম, ডাল কিংবা মসলার বেচাকেনাতেও।
মাত্র দুই দশক পেরিয়ে এখন খাতুনগঞ্জে এমন হাঁকডাক নেই। সে সময়ের বড় গ্রুপগুলোর অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছে। গুগলে অনুসন্ধান বাটনে ক্লিক করে কারও নাম পাওয়া যায় আদালতের শুনানির কার্যতালিকায়। কেউবা ব্যবসা পরিবর্তন করে অন্য শিল্পে সরব হয়েছে। কমেছে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। সেই জায়গা নিয়েছে ঢাকার গুটিকয়েক বড় শিল্পগ্রুপ। একসময় যে খাতুনগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যের উত্থান হয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মাণ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোনালি যুগের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে খাতুনগঞ্জ। আগের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই এখন। লেনদেন বাড়লেও ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমেছে। তাতে প্রতিযোগিতাও কমে গেছে। প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়ার জন্য যা ইতিবাচক নয়।
খাতুনগঞ্জের জৌলুশ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, দুই দশকে ভোগ্যপণ্যের বাজারের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ও পরিবর্তন এসেছে। তাতে খাপ খাওয়াতে না পেরে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বড় শিল্পগ্রুপের অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। কেউবা ব্যাংকের খেলাপি হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারেনি। মূলত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খাতুনগঞ্জের জৌলুশও কমে এসেছে। আবার দেশে নিত্যপণ্য মোড়কজাতের পরিমাণও বাড়ছে। তাতে খোলা পণ্যের অংশীদারি কমে খাতুনগঞ্জের অংশীদারি কমে গেছে।
খাতুনগঞ্জের যাত্রা শুরু হয়েছিল হামিদুল্লা মিয়ার বাজার থেকে। আবদুল হক চৌধুরী বন্দর শহর চট্টগ্রাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৮৫০ সালের দিকে) চট্টগ্রামের ইতিহাসপ্রণেতা ও ইংরেজ কর্মচারী খান বাহাদুর শেখ মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ খান (১৮০৯-১৮৮০) এই বাজার স্থাপন করেন। এই বাজারের পাশে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী খাতুন বিবির নিজস্ব জমিতে দোকানপাট গড়ে উঠতে থাকে। খাতুন বিবির নামে তা খাতুনগঞ্জ নামে পরিচিতি পায়। যদিও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন খাতুনগঞ্জের শতবর্ষ উদ্যাপন করে ২০১১ সালে।
হামিদুল্লাহ খানের বংশধরেরা এখনো চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছেন। হামিদুল্লাহ খানের ষষ্ঠ প্রজন্ম হামিদুল্লাহ খান অ্যাগ্রিকালচার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক মোরশেদ আহসান খান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে সে সময় কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই খালের পাড়ে পণ্য বাণিজ্য শুরু হয়। নদীপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় এই বাজার গড়ে তোলা হয়। ক্রমান্বয়ে তা খাতুনগঞ্জ হিসেবে রূপ পায়।
ইংরেজ আমলের মতো পাকিস্তান আমলেও খাতুনগঞ্জ ছিল এ অঞ্চলের পণ্য বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে পণ্য বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জ থেকেই। সে সময় অবাঙালিদের হাতে ছিল বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ। বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের আমদানি পণ্যের বিক্রেতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে আসে বাণিজ্য। সোনালি দিনের শুরুটাও স্বাধীনতার পর।
খাতুনগঞ্জকে কেন্দ্র করে আশপাশে অনেক পণ্য বাজার গড়ে উঠেছে। চাক্তাই, আসাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ ঘিরে পুরো এলাকা এখন খাতুনগঞ্জ নামেই পরিচিত। এ এলাকার প্রায় পাঁচ হাজারের মতো আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি ঢেউটিনসহ ইস্পাত পণ্য, রাসায়নিক ও নিত্যব্যবহার্য পণ্য বেচাকেনা হয় খাতুনগঞ্জে।
একসময় দেশে উৎপাদিত পণ্যই বেশি বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জে। ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশক থেকে আমদানিনির্ভর হতে থাকে নিত্যপণ্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যের পাশাপাশি আমদানিনির্ভর পণ্যও বেচাকেনা শুরু হয় খাতুনগঞ্জে।
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়ার বাজারের ৭২ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান মেসার্স বাচা মিয়া সওদাগর। পারিবারিক এই ব্যবসায় চার দশক ধরে যুক্ত আছেন বাচা মিয়া সওদাগরের ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিস। গত শনিবার নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নব্বইয়ের দশকের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল খাতুনগঞ্জ। সারা দেশের ব্যবসায়ীরা এখানে এসে পণ্য নিয়ে যেতেন। রাতেও চলত পণ্য বেচাকেনা। সেটি ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে এখন।
চাহিদা কম থাকায় তিন-চার দশক আগে অবশ্য পণ্য আমদানি হতো কম। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানি হয় ৯৪ হাজার টন, চিনি আমদানি ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার টন। এসব পণ্য বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জে।
ব্যবসায়ীরা জানান, তিন দশক আগেও সারা দেশের ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জে কার্যালয় খুলে ব্যবসা করেন। ঢাকার শিল্পগ্রুপের পাশাপাশি মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদেরও কার্যালয় ছিল এখানে। আবুল আইএস, নিপা এন্টারপ্রাইজের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা করেছে। রাজশাহী ও খুলনার ব্যবসায়ীরাও ছিলেন এ তালিকায়। ঢাকার সিটি গ্রুপও ভোজ্যতেলের তেল পরিশোধনাগার গড়ে তুলে চট্টগ্রামে। পারটেক্স গ্রুপের ব্যবসা শুরু হয়েছিল খাতুনগঞ্জ থেকে। হাশেম করপোরেশনের নামে শুরু করে পারটেক্স গ্রুপে রূপ নেয় পরে। খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য নিয়ে বেচাকেনা হতো মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শুরুতেও তথ্য-উপাত্তে খাতুনগঞ্জের ব্যবসার বড় অংশীদারির প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০০২-০৩ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া চাল, ডাল, গম, সয়াবিন তেল, পামতেল ও চিনি—এই ছয়টি নিত্যপণ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। এর ১২ লাখ টন বা ৬২ শতাংশই আমদানি করে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জেই বেচাকেনা চলত এসব পণ্যের।
খাতুনগঞ্জের বর্তমানে বাণিজ্যের অংশীদারি কেমন, তা জানতে আবারও তথ্যের শরণাপন্ন হওয়া যাক। চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাবে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রধান ছয়টি নিত্যপণ্য আমদানি হয় ৯২ লাখ টন। এসব নিত্যপণ্যের মধ্যে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এনেছেন ২০ লাখ টন বা ২২ শতাংশ। সে হিসাবে দুই দশকে প্রায় ৪০ শতাংশ অংশীদারি হারিয়েছে খাতুনগঞ্জ।
অংশীদারি কমলেও দুই দশক আগের তুলনায় খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের লেনদেন বেড়েছে। তবে দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারের আকার যেভাবে বেড়েছে, তার তুলনায় তা কম। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দুই দশকে ভোগ্যপণ্যের বাজারের আকার সাড়ে তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯২ লাখ টনে। সেখানে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের অংশীদারি বেড়েছে এক গুণেরও কম, মাত্র ৬৬ শতাংশ। মূলত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অংশীদারি কমেছে এই খাতে।
গত অর্থবছরে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রধান ছয়টি নিত্যপণ্য আমদানি করেছেন। প্রক্রিয়াজাত শেষে এসব পণ্যের বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। খাতুনগঞ্জে আমদানিকারক থেকে বড় পাইকারি ও ছোট পাইকারি পর্যায়ে অন্তত দুই থেকে তিন দফা পণ্যের হাতবদল হয়। এ হিসাবে গড়ে দিনে ২০০ কোটি টাকার নিত্যপণ্য বেচাকেনা হচ্ছে। আবার ঢাকার শিল্পগ্রুপের পণ্যও বেচাকেনা হয় খাতুনগঞ্জে। নিত্যপণ্য ছাড়াও মসলা, গুঁড়া দুধের মতো নিত্যপণ্যও বেচাকেনা হয়।
আগে ঢাকার ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের কার্যালয় খুলে ব্যবসা করতেন। এখন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঢাকায় কারখানা গড়ে ব্যবসা করছেন। কারণ, ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার ঢাকা। টি কে গ্রুপ দুই দশক আগে চট্টগ্রামের পাশাপাশি ঢাকায়ও নিত্যপণ্যের কারখানা গড়ে তুলেছে। ঢাকায় বৃহৎ ভোক্তাশ্রেণি গড়ে ওঠায় বাজারে টিকে থাকতে ঢাকামুখী হয়েছে টি কে গ্রুপ।
গত শনিবার খাতুনগঞ্জের সড়ক ধরে হেঁটে দেখা যায়, ছোট সড়কে ট্রাকের সারি। আগের মতো ব্যস্ততা বা জটলা নেই। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় টিনের ছোট বাটিতে চাল, ডাল, গমসহ হরেক পণ্যের নমুনা। পাশে ধুলাবালুমাখা খাতা। টেবিলে এসব পণ্য সাজিয়ে রেখে চেয়ারে বসে আছেন বিক্রেতারা। তবে ক্রেতা কম।
হামিদুল্লাহ মিয়া বাজারে আধা ঘণ্টা বসে একজন ক্রেতার দেখা পাওয়া গেছে। দরদাম করে পণ্য না কিনেই তিনি চলে যান। অবশ্য বড় পাইকারি প্রতিষ্ঠান আরএম এন্টারপ্রাইজে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সেখানে ১৫ জনের মতো কর্মী। ব্রোকাররা পণ্য বেচাকেনার জন্য দরদাম করছেন। মেঘনা গ্রুপ ও সিটি গ্রুপের দুজন কর্মকর্তাকে পাওয়া গেল সেখানে। ঢাকার এই দুটি বড় গ্রুপের পণ্যের লেনদেন হয় এখনো খাতুনগঞ্জে। সিটি গ্রুপের একজন কর্মকর্তা জানান, সিটি গ্রুপের মোট আমদানির ২০ শতাংশের মতো খাতুনগঞ্জে লেনদেন হয়।
খাতুনগঞ্জে আমির মার্কেট ছিল অফিসপাড়া। পণ্য লেনদেনের সরব অবস্থা ছিল সেখানে। শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পলেস্তারা খসে পড়া আমির মার্কেটের জরাজীর্ণ ভবন যেন সোনালি অতীতের সাক্ষ্য দিচ্ছে এখনো। সেখানেও এখন সরগরম অবস্থা নেই।
আশির দশকে নিত্যপণ্যের বাজার ছিল মূলত সরাসরি প্রস্তুত পণ্যের আমদানিনির্ভর। আশির দশকের মাঝামাঝি টি কে গ্রুপ প্রথম চট্টগ্রামে বেসরকারি খাতে বড় আকারের পরিশোধন কারখানা গড়ে তুলে। অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানিও শুরু হয় সে সময়। ধীরে ধীরে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ১২টি প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা গড়ে তোলে। ঢাকায় সিটি ও মেঘনা ছাড়া পাঁচটি ছোট আকারের রিফাইনারি ছিল। ফলে চট্টগ্রামের অংশীদারি ছিল বেশি।
ভোজ্যতেলের বাজারের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার শিল্পগ্রুপগুলো কারখানায় নতুন নতুন বিনিয়োগ করেছে। আবার পরিশোধনের পাশাপাশি বীজ থেকে তেল উৎপাদনের কারখানাও গড়ে তুলেছে ঢাকার সিটি ও মেঘনা গ্রুপ। অন্যদিকে ট্রেডিংনির্ভর চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা কারখানা সম্প্রসারণ করেননি। উল্টো লোকসানে বা নানামুখী ধাক্কায় কারখানা বন্ধ করেছেন।
এভাবে একসময় প্রস্তুত চিনি আমদানি করে বাজারজাত হতো। মোস্তফা গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপের পাশাপাশি ঢাকার মেঘনা ও সিটি গ্রুপ ছিল চিনি আমদানিতে। চাহিদা বাড়তে থাকায় নতুন শতকের প্রথম দশকে চিনি পরিশোধনের কারখানা গড়ে তোলেন উদ্যোক্তারা। চট্টগ্রামের এস আলম ছাড়া আর কেউ পরিশোধন কারখানায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসেনি। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকার পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পরিশোধন কারখানা গড়ে তোলে। তাতে চিনির ব্যবসাও খাতুনগঞ্জ থেকে সরে গেছে।
একইভাবে ছোট আকারের আটা-ময়দার কারখানা থেকে ঢাকার উদ্যোক্তারা বড় উৎপাদনক্ষমতার আটা-ময়দার কারখানায় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু চট্টগ্রামে বড় কারখানা গড়ে ওঠেনি। কারখানায় বিনিয়োগের পরিবর্তে ট্রেডিংয়ে মনোযোগ বেশি ছিল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা জানান, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের বড় অংশই ছিল ট্রেডিংয়ে বেশি মনোযোগী। সেই তুলনায় মৌলিক কারখানা গড়ে তোলার হার ছিল কম। ফলে ঢাকার সিটি, মেঘনা, বসুন্ধরার মতো বড় শিল্পগ্রুপ কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। তাতে ট্রেডিংনির্ভর বাণিজ্যে যারা ছিল তারা বাজারে টিকে থাকতে পারেনি।
আবার মোড়কে পণ্য ঢুকে যাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকায় খোলা পণ্যের বেচাকেনার হারও কমছে। বাজার এড়িয়ে শীর্ষস্থানীয় গ্রুপগুলো কারখানার গুদাম থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে প্যাকেটভরা আটা, ময়দা, সয়াবিন, ডালজাতীয় পণ্য। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, মোট নিত্যপণ্যের ২০ শতাংশ এখন প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করা হয়। তবে সয়াবিন তেলে এই হার বেশি।
ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় রূপান্তর ঘটছে। ঢাকার বৃহৎ ভোক্তাশ্রেণি ঘিরে সেখানে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা বাড়ছে। আবার স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিকে কেন্দ্র করে সীমান্ত এলাকায়ও পণ্যের বাণিজ্য বাড়ছে। বিভাগীয় শহরেও এখন পণ্যের বাণিজ্যের কেন্দ্র গড়ে উঠছে। একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তবে খাতুনগঞ্জে ব্যবসা কমেছে মূলত আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায়। তাতে পাইকারি ও ব্রোকার পর্যায়েও ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমেছে। এর অর্থ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় প্রতিযোগিতা কমে গেছে।
বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পর পণ্য আমদানিতে লাইসেন্স দরকার হতো। যারা লাইসেন্স পেত, তারা খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকের কাছে তা বিক্রি করে দিত। অর্থাৎ আমদানি করতেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। সে সময় দেশের আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের ৭৫-৮০ শতাংশ বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জে। লাইসেন্সিং প্রথা উঠে যাওয়ার পর তিন দশক আগে থেকে যে কেউ আমদানি করতে পারে। তাতে খাতুনগঞ্জ ছাড়িয়ে ঢাকাসহ অন্য এলাকায় আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে। এতে খাতুনগঞ্জের অংশীদারিও কমেছে।
মাহবুবুল আলম বলেন, খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাজারে প্রতিযোগিতাও কমে গেছে। আমদানি বা পাইকারি পর্যায়ে প্রতিযোগিতা থাকলে ভোক্তাদেরও প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য পেতে সুবিধা হয়।