বিদায়ী অর্থবছরে কাঁচামাল আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫১ শতাংশ। তার বিপরীতে প্রকৃত পোশাক রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ২৪ শতাংশ।
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ডলারের। তাতে মোট পোশাক রপ্তানির ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশই কাঁচামালের পেছনে ব্যয় হয়েছে।
তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। মোট পোশাক রপ্তানি থেকে কাঁচামাল আমদানির খরচ বাদ দিলে প্রকৃত পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় সাড়ে ২৪ শতাংশ। আর আগের বছরের চেয়ে কাঁচামাল আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫১ শতাংশ। সাধারণত, কাঁচামাল আমদানির চেয়ে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেশি হলেও বিদায়ী অর্থবছর ঘটেছে উল্টো ঘটনা। মাঝে ২০১৯-২০ অর্থবছর কাঁচামাল আমদানির চেয়ে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কম হয়েছিল। ওই বছর করোনার কারণে প্রচুর ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছিল বলে খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পোশাক রপ্তানি ও কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধির মধ্যকার অসামঞ্জস্য নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা বলছেন, বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্ববাজারে হঠাৎ করেই কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। কাঁচামালের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই হারে পোশাকের দাম বাড়েনি। সে কারণে কাঁচামাল আমদানি ও পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি সমান হারে হয়নি। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কাঁচামালের দাম বাড়লেও পোশাকের দাম সেই হারে বাড়েনি—এই বিষয় ঠিক থাকলেও কোথাও কোনো অনৈতিক কিছু হয়েছে কি না, মানে রপ্তানি আয়ের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক পোশাক রপ্তানির জন্য মূল ঋণপত্রের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে তুলা, সুতা, কাপড় ও কাঁচামাল আমদানির হিসাব নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। তাতে দেখা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তার বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ২১৮ কোটি ডলারের। ওই বছর কাঁচামাল আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর প্রকৃত পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কাঁচামাল আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। তার বিপরীতে প্রকৃত পোশাক রপ্তানি বেড়েছিল ১৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, একটি টি–শার্ট তৈরিতে গত বছরের শুরুতেও মোট খরচের ৪০ শতাংশ সুতার পেছনে ব্যয় হতো। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সুতার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ক্রেতারা সেই হারে পোশাকের দাম বাড়ায়নি। ফলে বর্তমানে একটি টি–শার্ট তৈরির ৫০ শতাংশ ব্যয় সুতার পেছনে হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা যদি ন্যায্যমূল্য দিত, তাহলে আমাদের মোট পোশাক রপ্তানিতে ৬০-৭০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতো।
অন্যদিকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। তাতে ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি কমে যায়। গুদামে প্রচুর অবিক্রীত পণ্য পড়ে থাকায় ব্র্যান্ডগুলো অনেক কারখানাকে ক্রয়াদেশের পণ্য বিলম্বে পাঠাতে বলেছে। সে কারণে পণ্য রপ্তানি হয়নি। কিন্তু সেসব পণ্য বানাতে আমদানি ঠিকই হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডলার পাচার দূরের কথা, কারখানাগুলো এখন লোকসানে আছে। ব্যাংক থেকে ঋণ করে শ্রমিকের মজুরি দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, রপ্তানি ও দেশের অভ্যন্তরের চাহিদা মেটাতে বিদায়ী অর্থবছরে পোশাকশিল্প–সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ২ হাজার ২২৫ কোটি ডলারের। তার মধ্যে তুলা ৪৪৩, সুতা ৫২৪, কাপড় ৯৯৩, কৃত্রিম তন্তু ১৫৬ এবং ডায়িংয়ের জন্য ব্যবহৃত উপাদান আমদানি হয়েছে ১০৬ কোটি ডলারের। তার মধ্যে তুলার আমদানি ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে সুতা ও কাপড় আমদানি বেড়েছে যথাক্রমে ১১৫ ও ৫১ শতাংশের মতো।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পোশাক রপ্তানি ও কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধির মধ্যে অস্বাভাবিক প্রবণতা থাকলেও কিছু যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন কাঁচামালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও সেই হারে পোশাকের দাম বাড়ায়নি বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। আমরা জরিপ করেও বিষয়টির সত্যতা পেয়েছি।’
সিপিডির এই গবেষক বলেন, বর্তমান ডলার–সংকটের সময় আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রপ্তানির ঋণপত্রে ওভারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে ডলার রেখে দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। আবার ঋণপত্র নিষ্পত্তি দেরিতে করতেও বিদেশি পার্টনারদের অনুরোধ করতে পারেন রপ্তানিকারকেরা। এই দুই কারণেও কাঁচামাল আমদানির তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে। ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন রকম তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে কি না, সেটিও তারা খতিয়ে দেখতে পারে।