অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে।
সিরামিকশিল্প খাতের ৭০টি কারখানার মধ্যে ২৫টি তিন মাসের বেশি সময় ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। এর মধ্যে দুই সপ্তাহ ধরে কারখানাগুলো দিনের অর্ধেক সময়, অর্থাৎ ১২ ঘণ্টাই গ্যাস পাচ্ছে না। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সিরামিক কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়ে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ)।
একই সঙ্গে তারা গ্যাস-সংকটে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সিরামিক কোম্পানিগুলোর সব ধরনের ঋণের কিস্তি পরিশোধে এক বছর অতিরিক্ত সময় দেওয়ার দাবি জানায়।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাকে লেখা ওই চিঠিতে বিসিএমইএর সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, তিন মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকার সাভার ও ধামরাই; নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও মেঘনাঘাট; গাজীপুরের কাশিমপুর, ভবানীপুর, ভাওয়াল মির্জাপুর, শ্রীপুর ও মাওনা; নরসিংদীর পাঁচদোনা; ময়মনসিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল এবং হবিগঞ্জের মাধবপুর ও বাহুবলের মোট ২৫টি সিরামিক পণ্য, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার কারখানায় তীব্র গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সিরামিক কারখানাগুলোয় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই (গ্যাসের চাপ মাপার একক) প্রয়োজন হয়। কিন্তু গ্যাসের চাপ কখনো তিন-চার পিএসআই থেকে শূন্যের কোঠায়ও নেমে আসছে। ১৫ দিন ধরে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না।
বিসিএমইএ বলছে, সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মোট ব্যয়ের ১২ শতাংশই হয় গ্যাসে। পণ্য প্রস্তুত করতে চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ থাকতে হয়। গ্যাসের চাপ কমে গেলে চুল্লির অভ্যন্তরে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় থাকা সব পণ্য তাৎক্ষণিকভাবে নষ্ট হয়ে যায়। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বন্ধ চুল্লি চালু করতে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে। অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। স্থানীয় বাজারেও সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।
‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী দুই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন।ইরফান উদ্দিন, বিসিএমইএর সাধারণ সম্পাদক
সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী, সিরামিক খাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। সর্বশেষ অর্থবছরে সিরামিক পণ্যের দেশীয় বাজারের আকার ছিল ৭ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সিরামিকের পণ্য (টেবিলওয়্যার) রপ্তানি করে আর্টিসান সিরামিকস। তাদের গাজীপুরের কারখানার দৈনিক উৎপাদনের সক্ষমতা সাত টন। গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ৩৫ শতাংশ কমে গেছে।
এ সম্পর্কে আর্টিসান সিরামিকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মামুনূর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন চালিয়ে নিতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়া হয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে সেখানেও সমস্যা হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
লোকসানে কারখানা চালাতে হচ্ছে দাবি করে মামুনূর রশীদ বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। ক্রয়াদেশ নেওয়াও কমাতে হয়েছে। এ জন্য ক্রেতারা বিরক্ত। তাঁরা আগামী বছর আমাদের ক্রয়াদেশ দেবেন কি না, সেটি নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।’
শীর্ষস্থানীয় টাইলস উৎপাদক আরএকে সিরামিকসের কোম্পানি সচিব মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাস-সংকটে আমাদের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ৪০ শতাংশের মতো কমেছে। আগে দিনে ৩২ হাজার বর্গমিটার টাইলস উৎপাদন করা হতো। সেটি কমে এখন ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার বর্গমিটারে নেমেছে।’
গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সিরামিকসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। এতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে বিসিএমইএর সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রী দুই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন।
একই সঙ্গে তাঁরা আমাদের কাছে সিরামিকের কারখানাগুলো কোথায় অবস্থিত এবং কারখানাগুলো কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত চেয়েছেন। কাল (আজ বুধবার) আমরা সেটি দেব।’