বিসিকের ৩৮টি শিল্পনগরীর ৪০০ জন উদ্যোক্তা ও ৩৬টি জেলা কার্যালয়ের ৫৪ জন কর্মকর্তা-প্রতিনিধির মতামত নেওয়া হয় জরিপে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীগুলোর প্রায় অর্ধেক কারখানায় গ্যাস–সংযোগ নেই। এ ছাড়া অধিকাংশ শিল্পনগরীতে নেই বিসিকের নিজস্ব পানি সরবরাহ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। এসব কারণে বিসিকের সেবা নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন সংস্থাটির শিল্পনগরীতে কারখানা গড়ে তোলা প্রায় ২০ শতাংশ শিল্পোদ্যোক্তা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিসিকের নিজস্ব উদ্যোগে করা এক গবেষণায় এ অসন্তুষ্টির কথা জানান উদ্যোক্তারা।
বিসিক শিল্পনগরীগুলোর বিদ্যমান অবস্থা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে উদ্যোক্তাদের ওপর এই গবেষণা চালিয়েছে সংস্থাটি। গত জুন মাসে গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তা এ নিয়ে তাঁদের শঙ্কার কথা জানান।
রাস্তাঘাট ও নালার পানি আটকে থাকা আমাদের এখানে বড় সমস্যা। একটু বৃষ্টি হলেই নালার পানি রাস্তা উপচে কারখানা পর্যন্ত চলে আসে। এ নিয়ে বিসিক ও স্থানীয় পৌরসভায় চিঠি দিলেও কোনো কাজ হয়নি।জহুরুল ইসলাম, সভাপতি, বিসিক জামদানি প্লট মালিক কল্যাণ সমিতি, নারায়ণগঞ্জ
সারা দেশে বিসিকের ৭৯টি শিল্পনগরীর মধ্য থেকে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ৩৮টি শিল্পনগরীর ৪০০ জন উদ্যোক্তা ও ৩৬টি জেলা কার্যালয়ের ৫৪ জন কর্মকর্তা-প্রতিনিধির মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পাশাপাশি সরেজমিনে এসব শিল্পনগরী পরিদর্শন করেও তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেছে বিসিক।
বিসিকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির বিভিন্ন শিল্পনগরীতে কারখানা স্থাপন করা প্রায় ২০ শতাংশ উদ্যোক্তা বিসিকের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এ ছাড়া প্রায় ১৫ শতাংশ উদ্যোক্তা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ফলে ধরে নেওয়া যায়, যাঁরা মন্তব্য করেননি, তাঁরাও বিসিকের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। মন্তব্য না করা উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় নেওয়া হলে বিসিকের সেবা নিয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ উদ্যোক্তা সন্তুষ্ট নন। আর সরাসরি সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন ৬৫ শতাংশ উদ্যোক্তা।
গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩৮টি শিল্পনগরীর ১৮২টি প্লট এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অব্যবহৃত প্লটের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর পরে আছে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশালের অবস্থান। আর ঢাকা, ময়মনসিংহ বিভাগে অব্যবহৃত প্লটের সংখ্যা কম। বিসিকের ৩৮টি শিল্পনগরীতে এখন রুগ্ণ কারখানা ৩৩৮টি। এর মধ্যে ঢাকাতে ১৬৭টি, চট্টগ্রামে ৮৪টি ও খুলনা অঞ্চলে ৪৫টি রুগ্ণ শিল্প রয়েছে।
শিল্পনগরীগুলোর প্লট বরাদ্দ, অব্যবহৃত ও রুগ্ণ কারখানা, গ্যাস–সংযোগ, বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি, নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থা এবং সড়ক ও নালার ব্যবহারের উপযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্যোক্তাদের মতামত নেওয়া হয় গবেষণায়। এ ছাড়া বর্তমানে শিল্পকারখানা স্থাপন ও সম্প্রসারণে কী ধরনের সমস্যা রয়েছে, তা–ও উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, তাঁদের কারখানার জন্য যে মাপের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। কারখানার জায়গা নিয়ে সবচেয়ে বেশি অসুবিধার কথা জানান ঢাকা অঞ্চলের উদ্যোক্তারা—এ হার ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ ঢাকা অঞ্চলের বিসিকের উদ্যোক্তাদের অর্ধেকই কারখানার জায়গা নিয়ে অসুবিধায় রয়েছেন। এ জন্য তাঁরা নতুন শিল্পনগরী স্থাপনের ক্ষেত্রে ঢাকা অঞ্চলকে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন।
উদ্যোক্তারা বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন গবেষণাকালে। ৬৭ শতাংশ উদ্যোক্তা মনে করেন, বিসিক শিল্পনগরীর রাস্তা, নালাসহ অবকাঠামোগত সমস্যাই সেখানকার শিল্প উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। ঢাকার জামদানি, লক্ষ্মীপুর ও পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর অভ্যন্তরীণ সড়ক ও নালার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, অধিকাংশ শিল্পনগরীর ড্রেন বা নালা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। তাই একটু বৃষ্টি হলেই নালার ময়লা পানি রাস্তায় ও কখনো কখনো কারখানায় ঢুকে যায়।
বিসিকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তা বলেছেন, তাঁদের কারখানার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সীমানাপ্রাচীর, সড়কবাতি ও নিরাপত্তা প্রহরীর ব্যবস্থা করা হয়নি। একই সঙ্গে শিল্প এলাকায় বহিরাগতদের উৎপাতকেও বড় সমস্যা বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে বিসিকের চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিল্পনগরীর চ্যালেঞ্জগুলো জানার জন্য এই গবেষণা করেছি। বেশ কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের কথা উঠে এসেছে। বিষয়গুলো আরও যাচাই করে দেখার জন্য নতুন করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা তথ্যগুলো যাচাই–বাছাই করে সুপারিশ জমা দেবে। এরপর আমরা পর্যায়ক্রমে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেব।’
গবেষণায় উঠে এসেছে, বিসিকের ১৫ শতাংশ শিল্পকারখানায় অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে জামদানি শিল্পনগরীর কোনো কারখানাতেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ ছাড়া প্রায় ৪৩ শতাংশ উদ্যোক্তা গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিসিকের বিভিন্ন পরিষেবা নিয়ে তাঁদের অসুবিধার কথা জানিয়েছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে, অন্তত ১২টি বিসিক শিল্পনগরীতে দীর্ঘদিন ধরে পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বিসিকের প্রায় ৫০ শতাংশ কারখানায় গ্যাস–সংযোগ নেই বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের শিল্পনগরীগুলো সবচেয়ে বেশি গ্যাস–সংকটে ভুগছে।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আর্থিক সংকট, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও কাঁচামালের অপর্যাপ্ততার কারণে প্রায় ৩৮ শতাংশ কারখানা সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। পাশাপাশি দক্ষ জনবল ও বাজারজাতকরণের সমস্যার কথাও তুলে ধরেছেন তাঁরা।
বিসিকের চারটি অঞ্চলের ৮১ শতাংশ শিল্পোদ্যোক্তা জানিয়েছেন, তাঁরা কারখানা সম্প্রসারণ করতে চান। কিন্তু ৭৫ শতাংশ উদ্যোক্তা জায়গার সংকট ও ৬১ শতাংশ আর্থিক সংকটের কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারছেন না। ২৭ শতাংশ উদ্যোক্তা প্লট বরাদ্দ ও ১৮ শতাংশ ঋণ পেতে সমস্যায় পড়ছেন বলে জানিয়েছেন। উদ্যোক্তারা বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্লট কিনে নিয়ে অধিক দামে বিক্রির জন্য ফেলে রাখছেন। এতে সমস্যায় পড়ছেন প্রকৃত উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ বিসিক জামদানি প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘রাস্তাঘাট ও নালার পানি আটকে থাকা আমাদের এখানে বড় সমস্যা। একটু বৃষ্টি হলেই নালার পানি রাস্তা উপচে কারখানা পর্যন্ত চলে আসে। এ নিয়ে বিসিক ও স্থানীয় পৌরসভায় চিঠি দিলেও কোনো কাজ হয়নি।’