দক্ষিণখানে গত বছর প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৬৫ ডলার বা ৬ হাজার ৮২৫ টাকা, যা ঢাকার গড় দামের চেয়ে ৭৮ ডলার কম।
ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম অনেক আগে থেকেই আকাশছোঁয়া। তারপরও প্রতিবছরই দাম বাড়ছে। ফলে অধিকাংশ এলাকাতেই ফ্ল্যাট কেনা মধ্যবিত্ত মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ১৪৩ দশমিক ৩১ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ধরে)। এই দামে ১ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাটের দাম দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
প্রতি বর্গফুটের গড় দাম ১৫ হাজারের ঘরে থাকলেও ঢাকার হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় এখনো ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকায় মাঝারি মানের ফ্ল্যাট কিনতে পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণখানে গত বছর প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৬৫ ডলার বা ৬ হাজার ৮২৫ টাকা। এটি ঢাকার গড় দামের চেয়ে ৭৮ দশমিক ৩১ ডলার কম। এ ছাড়া রামপুরায় প্রতি বর্গফুটের দাম ৫৭ ডলার বা ৫ হাজার ৯৮৫ টাকা। আর পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ৫৯ ডলার বা ৬ হাজার ১৯ টাকা।
বৈশ্বিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আরআইইউ) বরাত দিয়ে দেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এ দেশের আবাসন খাতে দামের একটি চিত্র তুলে ধরেছে। তাতে জানা যায়, ঢাকা শহরে বর্তমানে দক্ষিণখানেই সবচেয়ে কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে। রামপুরা ও গেন্ডারিয়া এলাকার অ্যাপার্টমেন্টের দামও দক্ষিণখানের কাছাকাছি।
আরআইইউর প্রতিবেদনমতে, পূর্বাচলে অ্যাপার্টমেন্টের দাম সবচেয়ে কম, অর্থাৎ প্রতি বর্গফুট ২৮ দশমিক ৩৭ ডলার বা ২ হাজার ৯৭৯ টাকা। রিহ্যাবের নেতারা অবশ্য বলছেন, ঢাকায়এত কমে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, নির্মাণসামগ্রীর দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে প্রতি বর্গফুটের নির্মাণ ব্যয়ই তিন হাজার টাকার বেশি। এর সঙ্গে জমির মূল্য যোগ করলে সেটি স্বাভাবিকভাবেই আরও বাড়বে।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান নির্মাণসামগ্রীর দাম হিসাব-নিকাশ করে জানিয়েছে, প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের নির্মাণ খরচ সাম্প্রতিক সময়ে ৪৪০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তাতে সাধারণ মানের প্রকল্পের ফ্ল্যাটের শুধু নির্মাণ ব্যয় বর্তমানে প্রতি বর্গফুট ৩ হাজার ৭৯০ টাকা পড়ে। মাঝারি মানের ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় ৪ হাজার ৩০৫ টাকা। অভিজাত ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে তা সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে ঢাকায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ শতাংশ অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে গুলশানে, ২২ হাজার ৮৭৬টি। তারপরের অবস্থানে রয়েছে ধানমন্ডি, যেখানে তৈরি হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৪টি। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে ১৪ হাজার ৮০২টি, মিরপুরে ১২ হাজার ১১১টি, বনানীতে ৮ হাজার ৭৪টি ও উত্তরায় ৬ হাজার ৭২৮টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে।
গত ১৩ বছরে ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম পৌনে দুই গুণ বেড়েছে। ২০১০ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৮১ দশমিক ২৬ ডলার। ৬ বছর পর তা ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনার আগে গত ২০১৯ সালেও প্রতি বর্গফুটের গড় দাম ছিল ১২৪ দশমিক ৩৪ ডলার। গত বছর সেটি বেড়ে এখন ১৪৩ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
ঢাকার গুলশানে তৈরি ফ্ল্যাটের দাম সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতি বর্গফুটের গড় দাম ১৬৬ ডলার বা ১৭ হাজার ৪৩০ টাকা। যদিও বর্তমানে গুলশানের পুলিশ প্লাজা থেকে গুলশান ২ নম্বর পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর নর্থ গুলশানে প্রতি বর্গফুটের দাম ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা।
গুলশানের পর অ্যাপার্টমেন্টের দাম সবচেয়ে বেশি হলো এর পার্শ্ববর্তী এলাকা বারিধারায়। এখানে গত বছর প্রতি বর্গফুটের গড় দাম ১৬০ দশমিক ৭৪ ডলার ছিল। দেশীয় মুদ্রায় এই দাম দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৮৭৮ টাকা। আর ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ গড় দাম ১৫৩ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ১৬ হাজার ৬৫ টাকা।
গত বছর বনানীতে ১২১ দশমিক ৩৬ ডলার, উত্তরায় ১১৫ দশমিক ১৯ ডলার এবং বসুন্ধরায় ৯৭ দশমিক ১৬ ডলার দামে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। একই বছরে অভিজাত এলাকার বাইরে মোহাম্মদপুরে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৮৪ দশমিক ২৬ ডলার বা ৮ হাজার ৮৪৭ টাকা। গড়ে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাট মতিঝিলে ৭৬ দশমিক ২৫ ডলার, বাড্ডায় ৭৫ দশমিক ৬৯ ডলার, বনশ্রীতে ৭২ দশমিক ২৬ ডলার, শান্তিনগরে ৭০ দশমিক ৫৬ ডলার, মিরপুরে ৬৯ দশমিক ১৭ ডলার, মহাখালীতে ৬৪ দশমিক ৬৯ ডলার এবং আগারগাঁওয়ে ৬১ দশমিক ১১ ডলারে বিক্রি হয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চলতি বছর প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে বলে জানান আবাসন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে ঢাকায় মানসম্মত ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুট সাড়ে সাত হাজার থেকে আট হাজারের নিচে পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। করোনার আগে মিরপুরে প্রতি বর্গফুট পাঁচ হাজার টাকায়ও মিলত। সেই মিরপুরে এখন দাম ৮-১০ হাজার টাকা।
ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটের দাম কমার সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে সোহেল রানা বলেন, ‘করোনার পর ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধির বড় কারণ নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য। নির্মাণসামগ্রীর দাম যদি না কমে, তাহলে দাম কমানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ভবন নির্মাণে উচ্চতাসংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ আবাসন খাতের পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। আশা করছি, ড্যাপে সংশোধন আসবে, তা না হলে নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতা নিয়ে বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়বে।’