বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে পাঁচ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়ে গেছে।
আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। তখন অর্থনীতি আবার পূর্ণ গতি পাবে।
কয়েক মাস ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেশ বেড়েছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে পাঁচ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এগুলো হলো মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে; শিল্পপ্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়েছে; জ্বালানি তেলের স্বল্পতা; আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রানীতি কঠোর করা।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক মনে করছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির এমন দশা হবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট’ প্রতিবেদনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সরকার চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। তখন অর্থনীতি আবার পূর্ণ গতি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
গত আগস্ট মাসে দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ফলে ওই মাসে খাদ্যপণ্য, যাতায়াত, পোশাক-আশাকসহ সব ধরনের খরচ বেড়ে যায়। গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ছিল ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসের পর এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ২০২৩ সালেও বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকবে। এটি ৯ শতাংশের বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধসহ পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কঠিনভাবে আঘাত করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভুগছে বাংলাদেশ। তাই শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না সরকার।জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ–সংকটে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকারকে পরিস্থিতি সামাল দিতে লোডশেডিং করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৯ সালের বাণিজ্যঘাটতির তুলনায় বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তৈরি পোশাকের চাহিদা না বাড়লে বাণিজ্যঘাটতি আরও বাড়তে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকার গাড়ি কেনা বন্ধ রাখা, বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করাসহ নানা ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।
ডলার–সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত জুন মাস থেকে এই পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৮ শতাংশ। এর মানে, টাকার মান কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৮০০ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতকে সহায়তা করতে এবং বিদেশি মুদ্রার চাহিদার চাপ কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণসহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক খাতে নানা ধরনের সংকটের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। চলতি ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় সাড়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। এর আগে সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় তা এখন কমিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া পাকিস্তানে ২ শতাংশ, নেপালে ৫ দশমিক ১ শতাংশ, ভুটানে ৪ দশমিক ১ শতাংশ, মালদ্বীপে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। শ্রীলঙ্কায় জিডিপি ৪ দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে।
কয়েক মাস আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। মূলত স্থানীয় ভোগ চাহিদা কমে যাওয়া, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হ্রাস এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি—এসব কারণে প্রবৃদ্ধির এমন পূর্বাভাস দিয়েছিল এডিবি।