২০১৫ থেকে ২০২০ সালে দেশে টার্কি পালনে সাফল্যের খবরে কয়েক হাজার উদ্যোক্তা এটি পালন শুরু করেন।
অনেকটা শখের বশে ২০১৩ সালে বিদেশি ‘টার্কি পাখি’ পালন শুরু করেছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মো. আবদুর রউফ। বছরখানেকের মধ্যেই তিনি দেখতে পান বাজারে এ পাখির চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে বাণিজ্যিকভাবে এই পাখি পালনের উদ্যোগ নেন তিনি। বিনিয়োগ করেন লক্ষাধিক টাকা।
টার্কির বাণিজ্যিক লালন–পালনের শুরুর দিকে ভালোই আয় হচ্ছিল আবদুর রউফের। তবে পাঁচ বছর না যেতেই তাঁর সেই বেচাকেনায় ভাটা পড়ে। একপর্যায়ে লোকসানের মুখে পড়ে ২০২১ সালে বন্ধ করে দেন টার্কির ব্যবসা। প্রথম আলোকে আবদুর রউফ বলেন, ‘হঠাৎ জনপ্রিয়তা পেলেও টার্কির টেকসই বাজার ও ভোক্তা চাহিদা তৈরি হয়নি। এ কারণে এই ব্যবসায় ভালো করতে পারিনি।’
এদিকে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে টার্কি পাখি পালনে সাফল্যের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। এসব সাফল্যের খবর শুনে আব্দুর রউফের মতো কয়েক হাজার উদ্যোক্তা দেশের বিভিন্ন স্থানে টার্কি পালন শুরু করেন। তবে ২০১৯ সাল থেকে চাহিদায় ভাটা পড়ে। করোনার পর দেশে টার্কির বাজার একদমই কমে যায়। বলা যায়, হঠাৎ এসে সাড়া ফেলে আবার হঠাৎই হারিয়ে যায় টার্কির ব্যবসা।
আমেরিকা ও ইউরোপে টার্কির অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে টার্কির কোনো ভোক্তা চাহিদা তৈরি হয়নি। এ কারণে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় এগিয়ে আসেনি।কাজী জাহেদুল হাসান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কাজী ফার্মস গ্রুপ
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের বর্ণনা অনুযায়ী, টার্কি মেলিয়াগ্রিডিডিই পরিবারের একধরনের বড় আকৃতির পাখিবিশেষ। দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও তুলনামূলকভাবে অনেক বড়। বিশ্বের সর্বত্র টার্কি গৃহপালিত পাখিরূপে লালন-পালন করা হয়। এরা পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। বাংলাদেশে লালন–পালন শুরুর পর থেকে এ পাখি টার্কি মুরগি হিসেবেই বাজারে বেশি পরিচিত।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় দেশে প্রায় পাঁচ হাজার খামারে ‘টার্কি মুরগি’ পালন হতো। এখন সেই সংখ্যা কয়েক শতে নেমেছে। বেচাকেনা সীমাবদ্ধ এখন শুধু অনলাইনে। বাজারে এ মুরগি খুব একটা দেখা যায় না। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের কিছু স্থানে টার্কি পালন করেন খামারিরা। তবে পোলট্রি বা ব্রয়লার মুরগির মতো টার্কির নিয়মিত কোনো ক্রেতা নেই।
সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও এখন টার্কি মুরগি পালনেরই বিপক্ষে। কারণ হিসেবে সরকারি এ সংস্থার মহাপরিচালক মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, ‘টার্কি মুরগির মাধ্যমে বার্ড ফ্লুসহ বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি। এ কারণে আমরা অনেক দিন ধরেই টার্কি পালন নিরুৎসাহিত করে আসছি।’
তবে টার্কি পালন নিয়ে সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) কিছু গবেষণা রয়েছে।
বর্তমানে বাচ্চার জোগান কমে গেছে, যথাযথভাবে ভ্যাকসিনেশন হচ্ছে না এবং খাদ্য খরচ অনেক বেশি। এসব কারণে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও টার্কি পালন টেকসই হতে পারেনি।মো. সাজেদুল করিম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএলআরআই
টার্কি মুরগি নিয়ে ২০১৬ সালে কিছু গবেষণা করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে টার্কির আগমন কীভাবে হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ২০–২৫ বছর আগে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ডিম নিয়ে এসে শখের বশে এ দেশে টার্কির পালন শুরু হয়। তবে ২০১৫–১৬ সালের দিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও ফেসবুক–ইউটিউবের মাধ্যমে টার্কি পালন বিষয়ে সাধারণ মানুষ জানতে পারেন।
এ কারণে হঠাৎ করে বাণিজ্যিকভাবে এটির লালন–পালন জনপ্রিয়তা পায়। খামারিরা তখন কোনো ধরনের সাত–পাঁচ না ভেবে ব্যাপকভাবে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা টার্কি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নামেন। একপর্যায়ে বাজারে টার্কির চাহিদা কমে যায়। ফলে অনেক খামারি ব্যবসায় লোকসানের মুখে পড়ে এই ব্যবসা ছেড়ে দেন। অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র বলেন, টার্কি দেশে ঝড়ের বেগে এসেছিল, আবার ঝড়ের বেগেই তা বাজার থেকে চলে গেছে।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুর দিকে এক দিন বয়সী প্রতিটি টার্কির বাচ্চা ৫০০–৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। পরে সেই দর ১৫০ টাকায় নেমে আসে। এক মাস বয়সী টার্কি আগে বিক্রি হতো ৭০০–৮০০ টাকা দরে। পরে তা আড়াই শ টাকায় নেমে আসে। আর পূর্ণবয়স্ক টার্কি বিক্রি হয় কেজি হিসেবে। প্রতি কেজি আগে বিক্রি হতো ২৫০–৩০০ টাকা দরে। পরে তা কমে দেড় শ টাকায় নামে।
টার্কি মূলত উত্তর আমেরিকার একটি পাখির প্রজাতি। অতীতে উত্তর আমেরিকা থেকে তুরস্কের জাহাজে করে টার্কি ইউরোপের বাজারে আনা হতো। এ কারণে একসময় এ পাখির প্রজাতিটির নাম হয়ে যায় টার্কি এবং সারা বিশ্বে এ নামেই ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে টার্কির মাংসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এরপর ইউরোপ, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভোক্তাশ্রেণি। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ইউরোপের দেশগুলো টার্কির প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। আর জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ টার্কির অন্যতম আমদানিকারক।
টার্কির প্রধান দুটি ধরন হচ্ছে হেরিটেজ টার্কি ও বাণিজ্যিক বা পোলট্রি টার্কি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি টার্কি পালন করা হয়। বাংলাদেশে পাওয়া যায় টার্কির হেরিটেজ ধরনটি।
গবেষকদের মতে, কোনো গবেষণা ছাড়াই এ দেশে টার্কির বাণিজ্যিক পালন শুরু হয়। বাজার যাচাই–বাছাই না করেই একশ্রেণির খামারি অতি লাভের আশায় টার্কির ব্যবসায় নেমে পড়েন। এ কারণে দীর্ঘ মেয়াদে টার্কির ব্যবসা আর টেকসই হয়নি।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাকিলা ফারুক বলেন, খামারিরা ঠিকভাবে টার্কির লালন–পালনের পদ্ধতি জানতেন না। পাশাপাশি এটির বাজার নিয়েও তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না। এসব কারণে তবে গত তিন–চার বছরে টার্কি পালন অনেক কমে গেছে।
এ ছাড়া টার্কির অতিরিক্ত ওজন এটি বাণিজ্যিক সফলতার পেছনে বড় বাধা ছিল বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুবাস চন্দ্র। তিনি বলেন, পাঁচ–ছয় কেজির বেশি ওজনের টার্কি কেনার সামর্থ্য অনেক ভোক্তারই ছিল না।
বেশ কয়েক বছর আগে টার্কি খামারিদের জন্য ঋণের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা টার্কি খামারিদের এ ঋণ দিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টার্কি পালন বাণিজ্যিকভাবে সফল না হওয়ায় এই ঋণপদ্ধতি বাতিল করা হয়।
টার্কির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে একটি মূল্যায়ন করেছিলেন বিএলআরআইর পোলট্রি রিসার্চ সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাজেদুল করিম। তিনি জানান, এক হাজার টার্কি যথাযথ প্রক্রিয়ায় পালন করলে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে ৬৮ হাজার টাকা লাভ থাকত। কিন্তু বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় টার্কি পালন আর বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হচ্ছে না। তাই বাচ্চার জোগান কমে গেছে, যথাযথভাবে ভ্যাকসিনেশন হচ্ছে না এবং খাদ্য খরচ অনেক বেশি পড়ছে। এসব কারণে টার্কি পালন টেকসই হয়নি।
দেশে নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রি মুরগি পালন শুরু হয়। প্রথম দিকে পোলট্রি মুরগি নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব ছিল। এ ছাড়া বার্ড ফ্লুসহ বিভিন্ন অনাকঙ্ক্ষিত রোগব্যাধির কারণে বেশ চড়াই–উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এই খাতকে।
বর্তমানে দেশে প্রোটিন চাহিদার অন্যতম উৎস এই পোলট্রি মুরগি। দেশের একাধিক বড় কোম্পানি পোলট্রি শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পোলট্রি শিল্প বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেও টার্কির পালন কেন সফল হতে পারল না? বড় কোনো গ্রুপই–বা কেন এগিয়ে এল না?
এ ব্যাপারে কাজী ফার্মস গ্রুপের এমডি কাজী জাহেদুল হাসান বলেন, ‘আমেরিকা ও ইউরোপে টার্কির অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে টার্কির কোনো ভোক্তা চাহিদা তৈরি হয়নি। এ কারণে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় এগিয়ে আসেনি।’
ডায়মন্ড এগ লিমিটেডের এমডি কায়সার আহমেদ বলেন, এত ওজনের প্রাণী বেশি দাম দিয়ে সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। আবার কেটে মাংস বিক্রির চলও এ দেশে নেই। তাই এটি সফল হয়নি।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বাজারগুলোতে এখন টার্কি বিক্রি করতে দেখা যায় না। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাজারে একসময় টার্কি বিক্রি হতো। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে কোনো টার্কি দেখা যায়নি। সিলেটের লালবাজারে আগে প্রচুর টার্কি বিক্রি হলেও গত বুধবার সেখানে পাওয়া গেল না টার্কির দেখা।
রাজধানীর কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাপ্তানবাজারে অনেক টার্কি বেচাকেনা হতো। শুধু নামের ওপরেই কিছুদিন এটি চলেছিল। পরে এটির বেচাকেনা একদমই কমে গেছে। বর্তমানে মাসে হয়তো ২–৪ জন ক্রেতা আসেন।’
বর্তমানে গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু টার্কি খামার রয়েছে। তাদের থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেে ব্যাপারীরা টার্কি নিয়ে বিক্রি করেন। এ ছাড়া শৌখিন অনেক ক্রেতা খাওয়া বা পালনের জন্য টার্কি কেনেন। তবে এসব কেনাকাটা ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই হয়।
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার খামারি শিরিন আক্তার ২০১৭ সাল থেকে টার্কি পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘আগে স্থানীয় বাজারে টার্কি মুরগি বিক্রি করতে পারতাম। বর্তমানে যেসব টার্কি বিক্রি হয়, তা প্রায় সবই অনলাইনে। শখের বশেই বেশির ভাগ ক্রেতা টার্কি কেনেন।’