দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।

দেশে নতুন–পুরোনো সব বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে

সারা বিশ্বে ২০২৩ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পৌনে ২ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ। ফলে টানা তিন বছর বৃদ্ধির পর দেশে এফডিআই আসা কমল। গত বছর বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা দেশি মুদ্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। ২০২২ সালে এফডিআই এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলারের।

নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি এফডিআই স্টক বা মোট বিনিয়োগের স্থিতিও কমে গেছে। গত বছর বিনিয়োগের স্থিতি কমে ২ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলারে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআই প্রাপ্তিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় এফডিআই প্রবাহ ১৭ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে বাংলাদেশের উল্টো কমেছে। ৪৫টি এলডিসির পাওয়া মোট এফডিআইয়ের ৫০ শতাংশই পেয়েছে পাঁচটি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ, গত বছরও তা–ই ছিল। শীর্ষ দুই দেশ হচ্ছে ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়া। আর চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে সেনেগাল ও মোজাম্বিক।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের চলতি বছরের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আঙ্কটাড।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে। ২০২০ সালে মহামারির সময় এফডিআই ২৫৮ কোটি ডলারে নামে। ২০২১ সালে আবার বাড়ে, যা পরের বছরও বজায় থাকে। ২০২১ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ২৮৯ কোটি ডলার।

বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ যেমন কমেছে, তেমনি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দেশের বাইরে বিনিয়োগও গত বছর কমেছে। গত বছর বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ডলারের বিনিয়োগ বিদেশে গেছে। তার আগের বছর বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

অবশ্য গত বছর বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বা গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের জন্য ঘোষিত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। এতে করে ভবিষ্যতে প্রকৃত বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে ৩৪টি প্রকল্পের জন্য ২৮৯ কোটি ডলারের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ২২ প্রকল্পের জন্য ৬৫ কোটি ডলার।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে সামগ্রিকভাবে এফডিআই প্রবাহ পৌনে ২ শতাংশ কমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির শ্লথগতি ও ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির কারণে এফডিআই প্রবাহ কমেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

সংস্থাটির মতে, উন্নত দেশগুলোতে গত বছর এফডিআই প্রবাহ ৯ শতাংশ বেড়েছে। ৪৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে উন্নত দেশগুলো। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এফডিআই কমেছে ৭ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলো সম্মিলিতভাবে গত বছর ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।

আঙ্কটাড বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গত বছরের তুলনায় গ্রিনফিল্ড বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এসব দেশে ৮ হাজার প্রকল্পে ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলার গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের ঘোষণা রয়েছে। যদিও উন্নত দেশে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা কিছুটা কমেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় গত বছর সার্বিকভাবে এফডিআই কমেছে ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ভারত ২ হাজার ৮১৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কম। পাকিস্তানে এফডিআই গেছে ১৮২ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায়ও এফডিআই কমেছে। তবে নেপাল ও মালদ্বীপে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। প্রথমত, নতুন বিনিয়োগ কমেছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ স্থিতিও কমেছে। বহু বছর ধরে আমরা সেভাবে নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না। বিদেশি যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে হারাচ্ছি। এটা আমাদের জন্য একটা বার্তা।’

মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, ‘বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়েছে খুবই সামান্য। আইনকানুনের প্রয়োগ খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নীতির ধারাবাহিকতা চায়। নতুন দেশে বিনিয়োগের সুরক্ষা দেখে। এসব জায়গায় আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে একটা নীতিকৌশল ও তার বাস্তবায়ন দরকার। কিন্তু তা নেই। সব মিলিয়েই আমরা পিছিয়ে আছি।’