তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের কল্যাণে সার্বিকভাবে পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। ফলে ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৮১%।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের পণ্য রপ্তানির সিংহভাগই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসছে। পোশাক রপ্তানি বাড়লে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় থাকে। আর পোশাক রপ্তানি কমলে পুরো রপ্তানি খাতই সংকটে পড়ে। চলমান বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। সে জন্য চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে সাড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে। রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার মূল্যের রেকর্ড পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্রথম আট মাসে রপ্তানি হয় ৩ হাজার ৩৮৪ কোটি ডলারের পণ্য। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এর চেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়াটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বস্তিদায়ক হলেও অধিকাংশ খাতেরই রপ্তানি কমছে। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কার্পেট, বিশেষায়িত টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য, হস্তশিল্প, আসবাব, কাঁচ পণ্য ইত্যাদি। তৈরি পোশাকের মতো চামড়া, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি বাড়ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো রয়েছে। সেখানে রপ্তানিও বাড়ছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যতটা সুযোগ আছে, ততটা কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে হবে।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
গতকাল বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, টানা তিন মাস সামগ্রিকভাবে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হলেও সদ্যবিদায়ী ফেব্রুয়ারিতে তা কমেছে। রপ্তানি হয়েছে ৪৬৩ কোটি ডলারের পণ্য। এই রপ্তানি গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি।
গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের সংকট তৈরি হয়। ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সেই সংকটকে গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আরও উসকে দেয় প্রবাসী ও পণ্য রপ্তানি আয়ের নিম্নগতি। নভেম্বর থেকে অবশ্য পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ঘুরে দাঁড়ায়। তবে গত মাসে প্রবাসী আয় আবারও কমেছে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে রপ্তানিকারকদের পোয়াবারো। কারণ, গত বছরের মার্চে তাঁরা ডলারপ্রতি ৮৫-৮৬ টাকা পেলেও বর্তমানে ১০৪ টাকা পাচ্ছেন।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের অবদান এখনো ৮৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৩ হাজার ১৩৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ০৬ শতাংশ বেশি। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি—এই তিন মাসে গড়ে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত মাসে তা অবশ্য ৩৯৪ কোটি ডলারে নেমে আসে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাপড় ও সরঞ্জামের উচ্চমূল্যের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু পোশাকের সংখ্যা বাড়ছে না। অনেক কারখানা এখনো উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৬০-৭০ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারছে। আগামী মৌসুমের নতুন ক্রয়াদেশের অনুসন্ধান প্রচুর এলেও চূড়ান্ত অনুমোদনের হার কিছুটা কম।’
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চামড়া খাতের রপ্তানির পরিমাণ ৮৩ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ বেশি। এই খাতে চামড়া রপ্তানি সাড়ে ১৪ শতাংশ কমলেও চামড়ার জুতা ও পণ্যের রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অন্যদিকে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি বেড়েছে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৩১ কোটি ডলারের পণ্য।
বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক, চামড়া, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। গত অর্থবছরে এই পাঁচ খাতের প্রতিটিতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলারের বেশি। যদিও চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটপণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে সুখবর নেই। অর্থাৎ রপ্তানি কমছেই।
আলোচ্য সময়ে ৭৬ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ৯৯ কোটি ডলারের চেয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ কম। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছে ৬১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ কম। গত কয়েক বছরে সম্ভাবনা দেখানো প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এই খাতে ৬২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ শতাংশ কম।
এদিকে প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৩৪ শতাংশ কমেছে। রপ্তানির পরিমাণ ৩৪ কোটি ডলার। প্রকৌশল পণ্যের মধ্যে বাইসাইকেল রপ্তানি হয় বেশি। আলোচ্য সময়ে ৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি হয়েছে। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ কম।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও সেখানে ব্যাংকের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রয়েছে।
এসব পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়লে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে। হাতছাড়া হবে বাজার। সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে তাঁদের সহায়তা দিতে হবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো রয়েছে। সেখানে রপ্তানিও বাড়ছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যতটা সুযোগ আছে, ততটা কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে হবে।