সেবা খাত

জাহাজ থেকে নাবিক পালিয়ে যাওয়ার পরিণতি

বিদেশের বন্দরে বাংলাদেশি নাবিকদের জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। ব্যক্তিগতভাবে কেউ এভাবে জাহাজ থেকে নেমে গেলেও তার ফল ভোগ করতে হয় নাবিক পেশাজীবীদের। দেশের ভাবমূর্তিও সংকটে পড়ে।

সাধারণত জাহাজ কোনো উন্নত দেশের বন্দরে গেলে সেখানকার বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের সবার জন্য সাময়িকভাবে শোরলিভ নামে একটা ‘পাস’ ইস্যু করে। ওই পাস দেওয়ার অর্থ জাহাজ বন্দরে থাকাবস্থায় আশপাশে ঘুরে বেড়াতে যেতে পারবেন নাবিকেরা। এটা অত্যন্ত চমৎকার এবং প্রয়োজনীয় একটা ব্যবস্থা। কারণ, একটানা দীর্ঘদিন সাগরে থাকার পর এই পাস নাবিকদের একগুঁয়েমি থেকে মুক্তি দেয়।

ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশের বন্দরে এমন সুযোগ অনেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে। শোরলিভে গিয়ে আর জাহাজে ফিরে আসেন না অনেক নাবিক। উন্নত দেশেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের কাছে এমন ঘটনা তেমন কোনো বড় বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের নাবিক পেশাজীবীদের তথা দেশের অর্থনীতির ওপর এটা কত ভয়াবহ প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা দিচ্ছি।

কয়েক মাস আগে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে জাহাজ থেকে দুজন বাংলাদেশি নাবিক পালিয়ে যান। বিদেশি ওই জাহাজটিতে একজন সেকেন্ড অফিসার, তিনজন নাবিকসহ মোট চারজন বাংলাদেশি ছিলেন। আগে যেমনটা বলেছি, জাহাজ বন্দরে গেলে পাস দেওয়া হয় এবং বাংলাদেশি দুজন শোরলিভে যাওয়ার নামে বের হয়ে আর জাহাজে ফেরত আসেননি। এ ঘটনার কয়েকটি ফলাফল সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

১. জাহাজে থাকা বাকি দুজন বাংলাদেশিকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা–ও স্বাভাবিকভাবে তাঁদের নামানো হয়নি, কানাডার কাস্টমস গার্ড দিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় বন্দীদের মতো। কতটা লজ্জা আর অপমানজনক একটা ব্যাপার, ভাবা যায়?

২. জাহাজ কোম্পানিকে ওই দেশের কর্তৃপক্ষকে প্রায় ১ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে অন্যান্য সব খরচ বাদে।

৩. জাহাজ বন্দরে আটক করা হয়। এতে প্রতিদিন জাহাজভাড়া বাবদ ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলার লোকসান দেয় কোম্পানিটি।

৪. আবার কানাডার কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা ও পরিদর্শন কার্যক্রম চালায়, জাহাজের কোনো খুঁত আছে কি না, তা খুঁজে বের করার জন্য। একের পর এক তদন্তকারী এসেছে জাহাজে, যা নিয়ে জাহাজের নাবিক থেকে মালিকপক্ষ সবার নাভিশ্বাস অবস্থা হয়েছিল।

৫. জাহাজ যারা ভাড়া করেছিল, তাদের ৪৫ মিলিয়ন ডলারের কার্গো সময়মতো পরের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে না পারায় বাড়তি লোকসান গুনতে হয়। সব মিলিয়ে কোম্পানিকে প্রায় কয়েক লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়েছে।

কানাডার বন্দরে যে দুজন বাংলাদেশি সেকেন্ড অফিসার চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের বেতন ছিল মাসে চার হাজার ডলারের বেশি। সে অফিসাররা আরও ছয় মাস জাহাজে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২৫ হাজার ডলারের জোগান দিতে পারতেন। কিন্তু ডলারের জোগান তো পরের কথা, এখন সেই কোম্পানির দরজা আজীবনের জন্য বাংলাদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ। এভাবে একের পর এক এসব ঘটনার জন্য আমাদের বিভিন্ন কোম্পানিতে নিষিদ্ধ করলে আমরা কোথায় চাকরি করব? কয়েকজনের স্বার্থান্বেষী কার্যক্রমের জন্য হাজার হাজার নাবিক ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন।

অনেকে ভাবতে পারেন, এটা বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা। কিন্তু সত্যি বলতে, এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রায় প্রতিবছরই কয়েকবার করে ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে কার্যকর এবং কঠোর কোনো আইন এখনো পর্যন্ত প্রণয়ন করা হয়নি। বাংলাদেশ মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশে একজন নাবিক পালিয়ে গেলে তার শাস্তি হলো পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এই আইন সংশোধন করা সময়ের দাবি।

১৯৭০ ও ৮০–এর দশকে ফিলিপাইনের নাবিকদের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। তারা কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই প্রবণতা শূন্যে নামিয়ে এনেছিল। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথাযথ, কার্যকরী এবং সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করে পালিয়ে যাওয়ার সব উপায় বন্ধ করবে।

লেখক: সাবেক ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম (৪৭তম ব্যাচ)