বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাওয়া চামড়া খাতের বাংলাদেশের সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চট্টগ্রামের কালুরঘাটের রিফ লেদার। কারখানাটিতে প্রক্রিয়াজাত করা ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট প্রস্তুত (ফিনিশড) চামড়া চূড়ান্ত পরিদর্শনের জন্য গত শুক্রবার চীন থেকে ক্রেতা প্রতিনিধি আসার কথা ছিল। কিন্তু দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্রেতারা তাঁদের এই সফর বাতিল করেছেন। ফলে এই বিপুল পরিমাণ চামড়া রপ্তানি সাময়িকভাবে আটকে গেছে।
এ ছাড়া রিফ লেদারকে দেওয়া জাপানের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আড়াই লাখ বর্গফুট চামড়ার ক্রয়াদেশও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর ইতালির একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ বর্গফুট চামড়ার ক্রয়াদেশের চুক্তিও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেট না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চার দিন (১৯-২২ জুলাই) বন্ধ থাকায় রিফ লেদারের আমদানি করা রাসায়নিক আটকে ছিল বন্দরে। রাসায়নিকের সংকটে সাত দিন উৎপাদন বন্ধ রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
টি কে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিফ লেদারের পরিচালক মো. মোকলেসুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদের সময় আমরা প্রচুর পরিমাণ কাঁচা চামড়া কিনেছি। এতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। কোরবানির ঈদের পর ভালো মানের চামড়া পাওয়া যায় বলে বিদেশি ক্রেতারা আসেন ও ক্রয়াদেশ দেন। কিন্তু দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে ভরা মৌসুমে আমরা একধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত, ভিয়েতনাম ও ইতালির কয়েকটি জুতার কারখানার সঙ্গে আমরা কাজ করি। আমাদের কারণে তারাও বিপাকে পড়েছে।’
বর্তমানে বড়দিনের ক্রয়াদেশ আসার সময়। এ সময়ে অনিশ্চয়তার কারণে ক্রয়াদেশ কমে গেলে রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বেনাসির খান, সহসভাপতি, এলএফএমইএবি
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রিফ লেদারের মতো রপ্তানিমুখী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়েছে। এমনিতে সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরে পরিবেশদূষণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে খাতটি ধুঁকছে।
চামড়া খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেশ কিছু রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজীকরণ করা যায়নি। এসব পণ্যে মূল্যছাড় দাবি করছেন বিদেশি ক্রেতারা। পাশাপাশি অনিশ্চয়তার কারণে নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি নিয়েছেন অনেক ক্রেতা।
খুলনার ফুলতলার উত্তর ডিহিতে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ ট্যানারি সুপারেক্স লেদার লিমিটেড। এটিও এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত কারখানা। দিনে এক লাখ বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রয়াদেশ নিয়ে সমস্যা না হলেও রপ্তানির অর্থ আসা পিছিয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে তারাও।
জানতে চাইলে সুপারেক্স লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘চলমান অস্থিরতার কারণে আমাদের রপ্তানির পাঁচ কোটি টাকা দেশে আসা পিছিয়ে গেছে।’
সমতা লেদার কমপ্লেক্স দেড় বছর ধরে সাভারের চামড়াশিল্প নগরের কঠিন বর্জ্য রপ্তানি করছে। চীনা এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্বোডিয়াতে তিন লাখ ডলারের কঠিন বর্জ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ গত সপ্তাহে চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। তবে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেটি করতে পারেনি সমতা লেদার কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে সমতা লেদার কমপ্লেক্সের পরিচালক ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রয়াদেশটি আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রতিযোগী অন্য দেশের সরবরাহকারীরা এ ক্রয়াদেশ পেয়েছেন।’ তিনি জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্যানারি খাতে এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল, স্থগিত ও পিছিয়ে গেছে।
হেমায়েতপুর চামড়াশিল্প নগরের সালমা ট্যানারির ১০-১২ লাখ বর্গফুট ক্রাস্ট চামড়ার একটি বড় ক্রয়াদেশ প্রাপ্তিও পিছিয়ে গেছে। এই ক্রয়াদেশ চূড়ান্ত করতে গত সপ্তাহে স্পেনের ক্রেতা প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। তবে অস্থিরতার কারণে ক্রেতাদের সফরটি বাতিল হয়।
সালমা ট্যানারির স্বত্বাধিকারী মো. সাখাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেতা প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসতে এখন আস্থা পাচ্ছেন না। এ কারণে চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ পাওয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে রপ্তানিতে নিশ্চিতভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার-জটের কারণে সময়মতো রাসায়নিক ছাড় করতে না পারায় উৎপাদন সচল রাখা নিয়েও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার প্রতিবছর বড় হচ্ছে। তবে সাত বছর ধরে এই খাতের বাংলাদেশের রপ্তানি একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১২৩ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানি হয় ৮৩ কোটি ডলারের।
জানতে চাইলে লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি নাসির খান বলেন, বর্তমানে বড়দিনের ক্রয়াদেশ আসার সময়। এ সময়ে অনিশ্চয়তার কারণে ক্রয়াদেশ কমে গেলে রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বেশ কিছুদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করেছে। ইতিমধ্যে নতুন ক্রয়াদেশ আসার গতি কমে গেছে। পাশাপাশি গত দুই সপ্তাহে সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ না হওয়ায় মূল্যছাড় ও এয়ার শিপমেন্টের মতো ঘটনা বাড়বে।