রংপুরের লিডিং স্টাইল নামের পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মোছা. ফজিলাতুন নেছা। তাঁদের একটি কারখানা রয়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারী এলাকায়। সেখানে পাটের ঝুড়ি, ব্যাগ ইত্যাদি উৎপাদন হয়। দুই মাস ধরে অত্যধিক লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানাটির একাংশ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা।
ফজিলাতুন নেছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আধা ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের চার-পাঁচ ঘণ্টা থাকে না। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকেরা কাজ করতে চান না। তাই বিদ্যুৎ–চালিত মেশিনগুলো বন্ধ রেখেছি। হাতে যতটুকু সম্ভব, সেটুকুই করছি। এতে পণ্য বিক্রি ৭০-৭৫ শতাংশ কমে গেছে।’ ডিজেল জেনারেটর কেন কিনছেন না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সেই সক্ষমতা নেই।’
লোডশেডিংয়ের কারণে লিডিং স্টাইলের মতো মফস্সলের কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলো এখন খুব ভুগছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই জেনারেটর কেনার মতো অর্থ নেই। ফলে কেউ কেউ লোকসান গুনছে। মফস্সলের যেসব এলাকা পল্লী বিদ্যুতের আওতায় রয়েছে, সেখানে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি বলে জানান তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ৪৬২টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। যদিও প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি সংস্থাটি। বিদ্যুৎ-ঘাটতি থাকলে নিয়মিত লোডশেডিং স্বাভাবিক ঘটনা। তবে বিদ্যুতের ঘাটতি না থাকলেও বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হন মফস্সলের গ্রাহকেরা। সামান্য ঝড়বৃষ্টি হলেও বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা না গেলে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। সে জন্য মফস্সলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।— আশরাফ আহমেদ, সভাপতি, ঢাকা চেম্বার।
নরসিংদীর রায়পুরার নারায়ণপুরের ক্রিয়েটিভ জুট টেক্সটাইল মিলসে পাটের মোটা কাপড় তৈরি করা হয়। সেই কাপড় দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ। কারখানাটিতে দুই শিফটে ৫০ জন কর্মী কাজ করেন। ক্রিয়েটিভ জুট টেক্সটাইল মিলসের স্বত্বাধিকারী অজিত কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনে-রাতে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদন সচল রাখতে ডিজেল জেনারেটর চালাই। এতে দিনে চার হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়। মাসের সব দিনই উৎপাদন হয়। তাতে জেনারেটরের পেছনে লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়।’
গাজীপুরের টঙ্গীর মাজুখান এলকার এক্সক্লুসিভ ক্যান নামক কারখানা রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধের বোতল তৈরি করে। লোডশেডিংয়ের মধ্যে উৎপাদন ঠিক রাখতে প্রতি মাসে তাঁদের লাখ লাখ টাকার ডিজেল কিনতে হচ্ছে।
এক্সক্লুসিভ ক্যানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসির জানান, গত মে মাসে ৯৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। লোডশেডিংয়ের মধ্যে জেনারেটর দিয়ে কারখানার উৎপাদন চালাতে তাঁদের ৩৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সরকারের বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম যেখানে ১২ টাকা, সেখানে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট খরচ পড়ে ৩৩ টাকা। লোডশেডিং পরিস্থিতি সামাল দিতে গত সপ্তাহে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর থেকে নতুন জেনারেটর ক্রয় করেছেন বলে জানান তিনি।
এক্সক্লুসিভ ক্যানের কারখানায় পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে। আর টঙ্গী বিসিকে তাঁদের আরেকটি কারখানা রয়েছে, যেটিতে ডেসকোর বিদ্যুৎ–সংযোগ রয়েছে। এমন তথ্য দিয়ে সৈয়দ নাসির বলেন, বিসিকের কারখানায় লোডশেডিং সেভাবে হয় না।
গত জুন মাসের শেষ দিকে দেশের বিভিন্ন জেলায় হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা কম ছিল। এতে সারা দেশে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তবে গত বুধবার থেকে লোডশেডিং আবার বাড়তে থাকে। গত মঙ্গলবার এক দুর্ঘটনায় পাইপলাইন ছিদ্র হওয়ায় কক্সবাজারের মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ কমে গেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। তখন ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। এই ঘাটতির কারণে লোডশেডিংয়ের অধিকাংশ হয়েছে মফস্সলে।
এ নিয়ে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে বড় শিল্পাঞ্চলের বাইরে তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব জায়গায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা না গেলে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। সে জন্য মফস্সলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’