গত অর্থবছরে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মোট রপ্তানি বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারে নেমে আসে। এর মধ্যে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি ছিল ২০ কোটি ডলার। এই খাতের রপ্তানি বাড়ছে।
এক দশক আগে ড্রাই ফুড বা শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানির বাজারে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী। প্রাণ-আরএফএল, স্কয়ার গ্রুপ, এসিআই ফুডসসহ কয়েকটি শিল্প গ্রুপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই বাজার। তবে বৈশ্বিক বাজারকে সামনে রেখে গত কয়েক বছরে রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন শিল্প গ্রুপ। এসব শিল্প গ্রুপ এত দিন দেশের বাজারে খাদ্যপণ্য বাজারজাত করে আসছিল।
দেশীয় বাজারের পাশাপাশি এখন রপ্তানিতে নজর দিয়েছে তারা। আবার দেশে ডলার-সংকট তৈরি হওয়ায় গ্রুপগুলো রপ্তানি বাড়াতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এখনো কোম্পানিগুলোর অন্যতম লক্ষ্য বিদেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাজার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এক দশক আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে শুকনা খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ছিল ৪ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলারের। মোট ১৭২ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ৪৩টি দেশে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে। এক দশকের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ কোটি ডলারে। বর্তমানে বিশ্বের ৯৩টি দেশে এসব খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে ২১২টি প্রতিষ্ঠান। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিস্কুট, কেক, মুড়ি, সেমাই, নুডলস, রুটি-পরোটা ইত্যাদি।
রপ্তানিতে বড়রা
খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে দীর্ঘ সময় ধরে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গত অর্থবছরও রপ্তানি হওয়া শুকনা খাদ্যপণ্যের ৪৯ শতাংশ একাই রপ্তানি করেছে গ্রুপটি। গত এক দশকে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল খায়ের গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, ইস্পাহানি গ্রুপ, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, টি কে গ্রুপ, আকিজ রিসোর্সেস ও সামুদা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান। এসব বড় গ্রুপের পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এসব পণ্য রপ্তানি করে আসছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) দেড় বছর ধরে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নজর দিয়েছে। গ্রুপটি তিন বছর আগে মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে মেঘনা নুডলস অ্যান্ড বিস্কুট কারখানা নামে খাদ্যপণ্য তৈরির কারখানা চালু করেছে। এ কারখানা থেকে রপ্তানি শুরু হয়েছে গত অর্থবছর।
জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার অনেক বড়। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে জোর দিয়েছি। উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে ও সরকারি সহায়তা দেওয়া হলে এটি রপ্তানির সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠবে।’
বড় শিল্প গ্রুপের মধ্যে এক বছর আগে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছে টি কে গ্রুপ। গ্রুপটি দেশে পুষ্টি ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য বাজারজাত করে আসছে। রপ্তানির শুরুতে গ্রুপটি মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে বিস্কুট, চানাচুর, সেমাইসহ নানা ধরনের খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে। গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা গ্রুপও খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করেছে।
জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে শুকনা খাদ্যপণ্য দেশের বাজারেই বাজারজাত করে আসছিলাম আমরা। এখন মূল্য সংযোজনের জন্যই বছরখানেক ধরে রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছি। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করেই আমাদের এই রপ্তানি।’
সিটি গ্রুপ আগে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করলেও শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত অর্থবছর থেকে। বিস্কুট, মুড়িসহ নানা রকমের শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছে গ্রুপটি। আকিজ রিসোর্সেস লিমিটেডও এক বছর আগে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করেছে।
মূলত খাদ্যশস্য, আটা, ময়দা, আলু ও দুধ এসব এক বা একাধিক উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় শুকনা খাদ্যপণ্য। খাদ্যপণ্য তৈরির কাঁচামালের বড় অংশই দেশে উৎপাদিত হয়। খাদ্যপণ্য তৈরির প্রধান উপকরণ গম এখনো আমদানিনির্ভর। বাকিগুলো দেশেই উৎপাদিত হয়।
বৈশ্বিক বাজারে হিস্যা কম
রপ্তানিতে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের একটি উপখাত হলো শুকনা খাদ্যপণ্য। কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজত পণ্যের মোট রপ্তানি বিলিয়ন ডলার থেকে কমে গত অর্থবছর ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারে নেমে আসে। এর মধ্যে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি ছিল ২০ কোটি ডলার। এই খাতের রপ্তানি বাড়ছে।
শুকনা খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার অনেক বড়। সে তুলনায় এই খাতে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো নিচের সারিতে। তবে বড় শিল্প গ্রুপগুলো এই খাতের রপ্তানিতে যুক্ত হওয়ায় এই খাতে রপ্তানি আয় বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তারা।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুকনা খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল ৯ হাজার ৭৭১ কোটি ডলারের। ২০২২ সালে বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৪তম। এক দশক আগে ২০১৩ সালে শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৭তম।
পরোক্ষভাবে প্রণোদনা দেওয়া যায়
দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলো খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে এমন সময়ে জোর দিয়েছে, যখন রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমিয়েছে সরকার। গত ৩০ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান অনুসারে কোনো ধরনের রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সে জন্য চলতি বছর থেকে অল্প অল্প করে নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে ১০০ টাকার পণ্য রপ্তানি করলে ২০ টাকা প্রণোদনা পেতেন রপ্তানিকারকেরা। এখন পাবেন ১৫ টাকা।
প্রণোদনা কমানোর কারণে উদ্যোক্তারা হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এ কারণে এই খাতের উদ্যোক্তাদের সরকারের সহযোগিতা দরকার।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, শুকনা খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক রপ্তানির বাজার বিশাল। বড় শিল্প গ্রুপগুলো শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নজর দিয়েছে, এটি ইতিবাচক দিক। এতে সামনে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আরও বাড়তে পারে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার বিধিবিধানের কারণে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হলে নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। এ জন্য এই খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যাতে টিকে থাকতে পারে, সে জন্য ভারতের মতো কৌশল নেওয়া যায়। যেমন সরাসরি প্রণোদনা না দিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা, রপ্তানি বাজার ধরার জন্য সহযোগিতা করা যায়।