দেড় মাসের বেশি সময় ধরে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কোনো পরিচালনা পর্ষদ নেই। পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সংগঠনটিতে প্রশাসক বসিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর প্রশাসককে সহায়তায় আছেন ১০ সদস্যের সহায়ক কমিটি। এরপরও পোশাকশিল্পের মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগের মতো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সংগঠনটি।
এদিকে প্রশাসক নিয়োগের পর ভোটার তালিকা সংশোধনসহ বিভিন্ন সংস্কারের দাবি তুলেছে সংগঠনটির সদস্যদের একাংশ। এরই অংশ হিসেবে গত মাসে সদস্য প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষাও শুরু হয়েছে। যদিও কয়েকজন সদস্য প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে প্রশাসককে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। ফলে শিগগিরই পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা করে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু করা নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
বিজিএমইএর কয়েকজন সদস্য জানান, বছরের পর বছর ব্যবসায় নেই, এমন অনেকে কৌশলে ভোটার হচ্ছেন। আর তাঁদের কেন্দ্র করে ভোটে অনিয়ম হয়। ব্যবসায় আছেন, এমন সদস্যদের কেবল ভোটার করাটা সংগঠনের জন্য মঙ্গল। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা করে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার। কারণ, শ্রম ইস্যু থেকে শুরু করে কারখানার নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার।
গত মার্চে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজিএমইএর সভাপতি হয়েছিলেন এস এম মান্নান, তিনি ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে সভাপতিসহ পর্ষদের অন্য সদস্যদের পদত্যাগের দাবি তোলেন নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট ফোরামের নেতারা। তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়েও এ বিষয়ে যোগাযোগ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২০ অক্টোবর বিজিএমইএতে প্রশাসক বসায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রশাসকের দায়িত্ব পান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট ফোরামের নেতারা বিভিন্ন সময় পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে সুষ্ঠু নির্বাচন, অনিয়ম তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তি, বিইউএফটির ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন সংস্কারের দাবি করেন। তবে বিতর্ক এড়াতে বর্তমান প্রশাসন কেবল ভোটার তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। সে জন্য গত মাসে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং নামের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানকে এক মাসের মধ্যে সংগঠনের ৩ হাজার ৩৬০ জন সদস্যের নিরীক্ষা ও যাচাই করতে বলা হয়। যদিও পুরো কাজটি শেষ হতে ডিসেম্বর, এমনকি মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এদিকে বিজিএমইএর ১০ জন সদস্য গত ২৫ নভেম্বর নিরীক্ষার উদ্যোগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে প্রশাসক আনোয়ার হোসেনকে আইনি নোটিশ পাঠান। নোটিশদাতা বিজিএমইএর নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট সম্মিলিত পরিষদের সমর্থক।
এ বিষয়ে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রশীদ আহমেদ হোসাইনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান দাবি, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বাণিজ্য সংগঠন আইন ও বিজিএমইএর সংঘবিধি অনুযায়ী, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স ও আয়কর রিটার্ন এবং কারখানা আছে, এমন সদস্যরাই ভোট দেওয়ার যোগ্য।’
প্রসঙ্গত, বিজিএমইএর গত নির্বাচনের আগে ২ হাজার ৫৬৩ জনের প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর ৪২৯ জনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন ফোরামের তখনকার দলনেতা ফয়সাল সামাদ। তাঁর অভিযোগের পর যাচাই–বাছাইয়ে ৬৭ জন ভোটার বাদ পড়েন। এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য এফবিসিসিআই আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন ফয়সাল সামাদ। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটির সুরাহা হয়নি।
দুই জোটের নির্বাচনী প্রস্তুতি
বিজিএমইএর নির্বাচনকেন্দ্রিক দুই জোট ফোরাম ও সম্মিলিত পরিষদ এরই মধ্যে আগামী নির্বাচনের দলনেতা চূড়ান্ত করেছে। ফোরামের দলনেতা হয়েছেন রাইজিং ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহমুদ হাসান খান। আর সম্মিলিত পরিষদের দলনেতা হন চৈতি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল কালাম। দলনেতা ঘোষণার মাধ্যমে উভয় জোটই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে।
জানতে চাইলে ফোরামের দলনেতা মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে পোশাকশিল্প যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে দ্রুত নির্বাচন হওয়াটা জরুরি। ভোটার তালিকা সংস্কার শেষ করে নির্বাচন করার মাধ্যমে প্রশাসকের দায়িত্ব শেষ হওয়া উচিত। আগামী সপ্তাহে আমরা প্রশাসকের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলব।’
গত ১৫ বছরে একবার ছাড়া সব মেয়াদেই সম্মিলিত পরিষদ বিজিএমইএর নেতৃত্ব দিয়েছে। সম্মিলিত পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান। প্রভাবশালী এই জোট গত মার্চের নির্বাচনে সব কটি পদে বিজয়ী হয়। যদিও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর টিপু মুনশি, আতিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম মুর্শেদী গ্রেপ্তার হন। সিদ্দিকুর রহমান ও এস এম মান্নানকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই সুযোগে সম্মিলিত পরিষদের সভাপতির পদে বসেছেন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন চৈতি গ্রুপের এমডি মো. আবুল কালাম—তিনিও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
জানতে চাইলে আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্মিলিত পরিষদ থেকে আমরা প্রশাসককে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালার বাইরে কোনো কাজ না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। আমরা চাই, প্রশাসক তাঁর নির্ধারিত ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন দিক।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়া পর শ্রম অসন্তোষসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করতে হয়েছে। বাণিজ্য সংগঠনের নির্বাচনকে অর্থবহ করতে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। পাশাপাশি বিজিএমইএর সদস্যদের নিরীক্ষার কাজও চলমান। ফলে আমরা শিগগিরই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে পারব বলে আশা করছি।’