ঈদ আসলেই তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে এক ধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত কয়েকটি কারখানার বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল।
অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা আজ দাবি করেছেন, তাদের সদস্য সচল কারখানার সবগুলোই শ্রমিকের গত মে মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছে। অন্যদিকে দুইটি শ্রমিক সংগঠনের নেতা বললেন, অনেক শ্রমিককেই বেতন-ভাতা পেতে কারখানার ভেতরে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। ভালো কিছু কারখানা ছাড়া অধিকাংশই শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দিয়েছে ‘নামমাত্র’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়টি তদারকি করে বিজিএমইএ। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংগঠনটির সচল কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৬০ টি। তার মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৮৩৫টি ও চট্টগ্রামে ৩২৫ টি। এসব কারখানার মধ্যে পাঁচটি গতকাল পর্যন্ত মে মাসের বেতন পরিশোধ করেনি। কারখানাগুলো হচ্ছে-গাজীপুরের টিএনজেড অ্যাপারেলস, অ্যাপারেলস প্লাস, বেসিক নিটওয়্যার ও বেসিক ক্লথিংয় এবং ডেনিস নিটওয়্যার।
বিজিএমইএ গতকাল শনিবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, তাদের সচল কারখানার শতভাগ গত মে মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছে। তবে চারটি কারখানার ঈদ বোনাস প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আজ বেলা পৌনে তিনটায় প্রথম আলোকে বলেন, চারটি কারখানার ঈদ বোনাস গতকালই পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে আর কোথাও বেতন-ভাতা পরিশোধ বকেয়া রয়েছে এমন কোনো তথ্য বিজিএমইএর কাছে নেই।
অন্যদিকে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আজ বেলা পৌনে ১২টায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২-৩ কারখানার বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে সমস্যা ছিল। ব্যাংকে অনুরোধ করে টাকা ছাড় করিয়ে কারখানাগুলোর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে কোনো কারখানার বেতন-ভাতা বকেয়া নেই। তবে দুই-একটি কারখানা গত মাসের ওভারটাইম পরিশোধ করতে পারেনি।’ কারখানাগুলো বোনাস কী হারে দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদ বোনাস দিয়েছে কারখানা। বেশির ভাগ কারখানা আগামী শনিবার থেকে খুলবে বলে জানান তিনি।
প্রায় এক মাস আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (আরএমজি-টিসিসি) সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল পবিত্র ঈদুল আজহার সরকারি ছুটি শুরু আগেই তৈরি পোশাকসহ সব খাতের শ্রমিকদের উৎসব ভাতা বা বোনাসসহ বেতন পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া ঈদের আগে কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই বা কারখানা বন্ধ করা যাবে না।
অবশ্য বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (বিজিআইডব্লিউএফ) সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বলেন, ১০-১৫ দিন আগে নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানা শতাধিক শ্রমিক ছাঁটাই করে। এ ছাড়া মাসখানেক আগে বিজিএমইএর একজন নেতার কারখানার ১২৫ জন শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হোন। চাকরি হারানো এসব শ্রমিকেরা বেতন-ভাতা, এমনকি ক্ষতিপূরণের কোনো অর্থ পাননি।
বাবুল আক্তার আরও বলেন, শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালায় শ্রমিকের বোনাসের পরিমাণ নিয়ে কিছুটা জটিলতা রয়ে গেছে। আইন ও বিধিতে বলা হয়েছে, বোনাস মূল বেতন বা বেসিকের বেশি হবে না। তবে কতটা হবে না সেটি বলা নেই। এই সুযোগে ইচ্ছেমতো বোনাস দেয় কারখানাগুলো। কিছু ভালো কারখানা দুই ঈদে শ্রমিকদের দুইটি মূল বেতনের সমপরিমাণ বোনাস দেয়। অনেকে একটি মূল বেতন দুই ঈদে ভাগ করে দেয়। আবার নামমাত্র ৫০০,১ হাজার বা ২ হাজার টাকা বোনাস দেয় বহু কারকানা। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে চাকরির বয়স ১ বছরের নিচে হলে বোনাস দেয় না অধিকাংশ কারখানা। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে এমন শ্রমিকের সংখ্যা ১২-১৫ শতাংশ।
অন্যবারের মতো এবারের ঈদেও অনেক কারখানার পোশাকশ্রমিকের বেতন-ভাতা প্রাপ্তি মসৃণ হয়নি বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের একাংশ গত মাসের আংশিক বেতন পেয়েছে। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের বোনাসের জন্য কারখানায় দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়েছে। কারখানার ভেতরে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে, যদিও বেতন-ভাতা নিয়ে বড় কোনো শ্রমিক আন্দোলন হয়নি।