কয়েলের বাজারে একসময় রেকিট অ্যান্ড বেনকাইজারের মরটিন, এসিআই, ভারতের গোদরেজের গুডনাইট, কাজী এন্টারপ্রাইজের ইগল, গ্লোবসহ আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড বেশ সুপরিচিত ছিল। ২০১২ সালের দিকেও এ বাজারে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর হিস্যা ছিল ৫৫ শতাংশের বেশি। এখন সেই হিস্যা কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে।
দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর কেউ কেউ এরই মধ্যে কয়েলের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উৎপাদন একেবারে বন্ধ না করলেও সীমিত পরিসরে কারখানা চালু রেখেছেন। তাতে মশার কয়েলের বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হিস্যা ক্রমেই কমছে। তার বিপরীতে বাড়ছে নন-ব্র্যান্ডের হিস্যা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের কয়েলের বাজারের বড় অংশই এখন নন-ব্র্যান্ডের দখলে।
এদিকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে কয়েলসহ মশা নিধনের স্প্রে, র্যাকেট, তরল ওষুধসহ নানা ধরনের সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। তাতে কিছু কিছু পণ্যের দামও বেড়েছে। বাজারটি নন-ব্র্যান্ডের হাতে চলে যাওয়ায় দামের ক্ষেত্রে একধরনের বিশৃঙ্খলাও দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে কয়েলের বাজারে একসময় রেকিট অ্যান্ড বেনকাইজারের মরটিন, এসিআই, ভারতের গোদরেজের গুডনাইট, কাজী এন্টারপ্রাইজের ইগল, গ্লোবসহ আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড বেশ সুপরিচিত ছিল। ২০১২ সালের দিকেও এ বাজারে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর হিস্যা ছিল ৫৫ শতাংশের বেশি। এখন সেই হিস্যা কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। ব্র্যান্ড-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় চীন থেকে অনুমোদনহীন প্রচুর কয়েল বাজারে আসতে শুরু করে। একপর্যায়ে চীনের অনুমোদনহীন কয়েল বাজারের একটি বড় অংশ দখল করে নেয়। এরপর দেশেও ছোট ছোট কারখানা গড়ে ওঠে।
ব্যবসায়ী ও খাত সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, দেশে ছোট ছোট কয়েলের যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তারা ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করে কয়েল উৎপাদন করে। উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে এসব কয়েল দ্রুত মশা তাড়ায় বা নিধন করে ঠিকই, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দেশের কমপ্লায়েন্ট বা মানসম্পন্ন কারখানাগুলো ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করে না। কারণ, তাদের এ-সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলতে হয়। ফলে নন-ব্র্যান্ডের কয়েলের কাছে ব্র্যান্ডের কয়েল বাজার হারায়।
জানতে চাইলে এসিআইয়ের পরিচালক (ব্যবসা) কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নন-ব্র্যান্ডের কয়েলগুলোর গুণগতমান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের অভিযোগ আছে এসব কয়েলে। আমাদের পক্ষে যেটা করা সম্ভব নয়। এ জন্য বড় কোম্পানিগুলো এ বাজার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।’
বাজারসংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, দেশে মশার কয়েল, স্প্রে ও তরল ওষুধের মতো পণ্যের বাজার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ বাজারই কয়েলের দখলে। বাকিটা অন্যান্য পণ্যের। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত দুই বছরে দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে মশার স্প্রে বা তরল ওষুধের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের মতো। আর কয়েলের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। ৫০ টাকার মশার কয়েলের প্যাকেটের দাম বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা।
দেশে নন-ব্র্যান্ড কয়েল উৎপাদনের বড় হাবগুলোর অন্যতম ভৈরব। এ ছাড়া কারখানা গড়ে উঠেছে যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায়। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ মসকিউটো ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন ভৈরবের সাধারণ সম্পাদক মুরাদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে কয়েলের কারখানার সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছিল। তবে এখন ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে পণ্যমূল্য বাড়েনি।’
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) তথ্য বলছে, সারা দেশে বৈধভাবে কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে ১২৫টি। এর মধ্যে বড় ও মাঝারি মানের কোম্পানি আছে মাত্র ৫ থেকে ৭টি। বাকিরা ছোট ছোট কারখানা গড়ে তুলে কয়েল উৎপাদন করে থাকে। আর স্প্রের বাজারে স্কয়ার ও কাজী এন্টারপ্রাইজের মতো করপোরেট প্রতিষ্ঠান থাকলেও, এই বাজারের বেশির ভাগ এসিআইয়ের হাতে।
মানভেদে দেশের বাজারে ৮০০ মিলি একটি মশার স্প্রের দাম ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। আর মানভেদে কয়েলের দামও ভিন্ন ভিন্ন। বাজারে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় প্রতি প্যাকেট মশার কয়েল বিক্রি হয়। বাজারে দেশে তৈরি কয়েলের পাশাপাশি চীন থেকে আমদানি করা কয়েলও পাওয়া যায়। আর মশা মরার তরল ওষুধের পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এসব তরল ওষুধ টিউবে করে বিক্রি করা হয়।
এ ছাড়া শিশুদের মশার কামড় থেকে বাঁচাতে ক্রিমও পাওয়া যায় এখন বাজারে। শিশুদের এ ক্রিমের বাজারটি ওডোমসের দখলে, এটি ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
বেড়েছে মশকনিধন পণ্যের বেচাকেনা
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার অনেক বেশি। তাই বাজারে মশার কয়েল ও স্প্রের বিক্রি বেড়ে গেছে। এমনিতে বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব পণ্যের বিক্রি বেশি হয়। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য বছরের চেয়ে এসব পণ্যের বেচাকেনা তিন থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। মশার কয়েল ও স্প্রের পাশাপাশি বিক্রি বেড়েছে মশারিরও। বাজারে ২০০ টাকা থেকে হাজার টাকা দামের ছোট-বড় মশারি পাওয়া যাচ্ছে। মানভেদে প্রতিটি মশারির দাম ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এ ছাড়া বেড়েছে মশা মারার বৈদ্যুতিক র্যাকেটের দামও। একেকটি র্যাকেট মানভেদে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নন-ব্র্যান্ডের র্যাকেটের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়লেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ তাদের র্যাকেটের ৫০ টাকা কমিয়েছে। কোম্পানিটির প্রতিটি র্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪৭০ টাকায়। প্রাণ-আরএফএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণ সময়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার মশার র্যাকেট বিক্রি হয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এখন বিক্রি বেড়ে মাসে ৬০ হাজারের পৌঁছেছে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব}