পোরশে, অডিসহ দামি গাড়ির বাজার দেশে বড় হচ্ছে

ফাইল ছবি

দুই দশক আগেও ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় টয়োটার ভিড়ে দেখা মিলত দু-একটি রেঞ্জ রোভার, অডি, মার্সিডিজ কিংবা বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের দামি গাড়ি। এখন রাস্তায় বেরোলেই অহরহ চোখে পড়ে ইউরোপীয় নানা ব্র্যান্ডের গাড়ি। আবার স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল বা এসইউভির মতো দামি গাড়ির দাপটও বেড়েছে সড়কে। খুব বেশি দেখা না মিললেও বেন্টলি, মাসেরাতি, পোরশে ব্র্যান্ডের গাড়িও আমদানি হচ্ছে এখন।

বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার কেমন বাড়ছে, তার উদাহরণ হতে পারে দুই দশকের আমদানি পরিসংখ্যান। দুই দশক আগে বছরে ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হতো বড়জোর ৫০-৬০টি। এখন বছরে এ ধরনের গাড়ি আমদানি হচ্ছে গড়ে ৫০০টির বেশি।

আবার অভিজাত গাড়ি হিসেবে পরিচিত এসইউভি গাড়ির বাজারও বড় হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে এসইউভি শ্রেণির গাড়ি ছিল মোট আমদানির ৮ শতাংশ। আর দুই দশকের মাথায় ২০২২ সালে যত গাড়ি আমদানি হয়েছে তার ৪০ শতাংশই ছিল এসইউভি শ্রেণির। সংখ্যার হিসাবে তা ১০ হাজার ৬৪৯। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এসইউভি গাড়ি নিবন্ধন হয় ১০ হাজার ২৪০টি, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি।

গাড়ি বিক্রেতারা জানান, দুই দশকের তুলনা করলে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। এ সময়ে দেশে উচ্চবিত্তের পাশাপাশি উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য উল্লেখ করা যায়। সংস্থাটির ২০২২ সালের সর্বশেষ হিসাবে, ২০২১ সালে দেশে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ২৮ হাজার ৯৩১। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ গাড়ির পরিবর্তে অভিজাত এসইউভি কিংবা বিলাসবহুল ইউরোপীয় গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা।

সেডান কার থেকে এসইউভি

এক দশক আগেও দেশের গাড়ির বাজারে ছিল সেডান কারের আধিপত্য। এখনো সেডান কারের আধিপত্য থাকলেও ধীরে ধীরে তা পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়ছে এসইউভি শ্রেণির গাড়ির চাহিদা। এ কারণে ব্যবসায়ীরাও আমদানি বাড়িয়েছেন এ ধরনের গাড়ির।

নতুন ও পুরোনো—এই দুই রকম গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে এসইউভি শ্রেণিতে। সেডান কারের মতো পুরোনো এসইউভি গাড়ি আসছে জাপান থেকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ি। জাপান ছাড়াও চীন, ভারত ও কোরিয়ার এসইউভির নতুন গাড়ি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

এসইউভি গাড়ি জিপ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে। সেডান কারের তুলনায় এ গাড়িগুলো একটু উঁচু ধরনের। এসইউভি শ্রেণির মধ্যে আবার কয়েক ধরনের গাড়ি আছে। দূরের যাত্রাপথে এ ধরনের গাড়ি আরামদায়ক। সেডান কারের চেয়ে আকারে বড় হওয়ায় দূরের যাত্রায় এ ধরনের গাড়িকে নিরাপদও মনে করছেন ব্যবহারকারীরা।

গাড়ির বাজারের এই পরিবর্তন বিষয়ে বিক্রেতারা জানান, বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা এখন এসইউভি গাড়ির দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে গাড়ির এই বাজার ধরতে এসইউভি গাড়ির সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি কমিয়ে হাতের নাগালে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন যেমন এসইউভি নতুন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ৩২ লাখ টাকায়ও। আবার ৭-৮ কোটি টাকা দামের এসইউভিও আমদানি হচ্ছে দেশে। যেমন টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার এলসি ৩০০ শ্রেণির তিন হাজার ৩০০ সিসির একেকটি গাড়ির দাম পড়ছে সাত কোটি টাকার বেশি।
গাড়ি ব্যবসায়ী ও বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, এক দশকের হিসেবে এসইউভি গাড়ি বিক্রি বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ। সবচেয়ে বেশি বিক্রি বেড়েছে গত সাত বছরে। এ সময় এসইউভি শ্রেণির গাড়ি বিক্রি হয়েছে ৪৪ হাজার। গত বছর এসইউভি গাড়ি বিক্রিতে রেকর্ড হয়। মোট ১০ হাজার ২৪০টি এসইউভি গাড়ি বিক্রি হয়।

টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ির পরিবেশক নাভানা লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক নাসিমুল গণি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় সেডান কারের আধিপত্য ছিল বেশি। পাঁচ বছর ধরে এসইউভি ধরনের গাড়ির দিকে ঝুঁকছে ক্রেতারা। নাভানারও এসইউভি গাড়ি বিক্রি হচ্ছে বেশি।

সেডান কারের মতো এসইউভি গাড়ির মধ্যে হাইব্রিড গাড়িও আমদানি হচ্ছে। হাইব্রিড গাড়ি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের সমন্বয়ে চালানো যায়। এই দুই শক্তি গাড়ির প্রয়োজন অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়।

গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেল ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) মহাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত গাড়ির দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে সেডান কারের পাশাপাশি এসইউভি শ্রেণির পুরোনো গাড়ি আমদানি বেড়েছে। ক্রেতাদের ঝোঁক থাকায় আমদানিও প্রতিবছর বাড়ছে।

বড় হচ্ছে ইউরোপীয় গাড়ির বাজার

দুই দশক আগেও বছরে ৫০-৬০টি ইউরোপীয় গাড়ি আমদানি হতো দেশে। এই সংখ্যা গত পাঁচ বছরে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। এখন বছরে ৫০০টির বেশি গাড়ি আমদানি হচ্ছে ইউরোপীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের। ইউরোপীয় গাড়ির মধ্যে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, রেঞ্জরোভার ও অডি—এই চার ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বেন্টলি, পোরশে, মাসেরাতি গাড়িও এখন আমদানি হচ্ছে। সংখ্যায় কম হলেও সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি রোলস রয়েসও রয়েছে দেশে। জাগুয়ার, ক্যাডিলাকও আমদানির রেকর্ড রয়েছে।

ইউরোপীয় গাড়ির মধ্যে বড় বাজারটি জার্মান বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণ সংস্থা মার্সিডিজের দখলে। গত পাঁচ বছরে এই ব্র্যান্ডের ৯৭৬টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর ৫৯ শতাংশ বা ৫৭৮টি আমদানি হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের মধ্যে মে ব্যাচ হাইব্রিড জিপ শ্রেণির গাড়ি সবচেয়ে দামি। গাড়িটির সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি ৩ হাজার ৯৮২। সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি বেশি হওয়ায় গাড়ির করভারও বেশি। এই গাড়িটির আমদানিমূল্য দেড় লাখ ডলার। শুল্ককরসহ দাম পড়ছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এরপরেই রয়েছে তিন হাজার সিসির জিএলএস শ্রেণির হাইব্রিড জিপ ও এএমজি (ফোর ম্যাটিক) গাড়ি।

ইউরোপীয় গাড়ি আমদানির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থান বিএমডব্লিউ। গত পাঁচ বছরের এ ব্র্যান্ডের ৪৩১টি গাড়ি আমদানি হয়। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় গত বছর, মোট ১৩০টি। এই ব্র্যান্ডের নতুন নতুন শ্রেণির গাড়ি আসছে বাংলাদেশে। সর্বশেষ গত বছর দেশে বিএমডব্লিউ এক্স সেভেন শ্রেণির গাড়ি বাজারজাত শুরু করে এক্সিকিউটিভ মোটরস। এই গাড়ির আমদানিমূল্যই ৮১ হাজার ডলার বা ৮৫ লাখ টাকা। করভার দুই কোটি টাকার কাছাকাছি। বিএমডব্লিউ এক্স সেভেন গাড়ির দাম শুরু ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা থেকে।

রাস্তায় এখন রেঞ্জ রোভার গাড়িরও দাপট দেখা যায়। গত পাঁচ বছরে এই ব্র্যান্ডের ৩৬০টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। রেঞ্জ রোভার ভোগ শ্রেণির গাড়ির আমদানিমূল্য পড়ছে ৭০-৭৪ হাজার ডলার। করভার ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তাতে এ ধরনের গাড়ির আমদানিমূল্য পড়ছে সোয়া দুই কোটি টাকা।

অডি গাড়িরও আমদানি বাড়ছে দেশে। গত পাঁচ বছরে অডি গাড়ি আমদানি হয়েছে ২৯৭টি। গত বছর ৬৯টি গাড়ি আনা হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে অডি গাড়ির পরিবেশক প্রোগ্রেস মোটরস ইমপোর্টস লিমিটেড। অডি কিউ-৭ ও কিউ-৮—এই দুই শ্রেণির গাড়ি আমদানি হচ্ছে বেশি। বাজারে এ দুই ধরনের গাড়ি বিক্রি হচ্ছে ২ কোটি ৯ লাখ থেকে সোয়া ২ কোটি টাকায়।

জানতে চাইলে অডি গাড়ির পরিবেশক প্রোগ্রেস মোটরস ইমপোর্টসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ফজলে সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাজারে অডি গাড়ির চাহিদা বাড়ায় আমদানিও বাড়ছে। সচ্ছল ক্রেতারা এখন দামি গাড়ির প্রতি ঝুঁকছেন।

সংখ্যায় কম হলেও আসছে বিলাসবহুল গাড়ি

বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি যুক্তরাজ্যের রোলস রয়েস। গাড়ি বিক্রেতাদের হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে এই গাড়ি রয়েছে অন্তত পাঁচটি। তবে কাস্টমসের হিসাবে গত পাঁচ বছরে মাত্র দুটি রোলস রয়েস গাড়ি আমদানির তথ্য পাওয়া যায়। এই দুটি গাড়ির সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি ৬ হাজার ৭৫০। তার মধ্যে একটি আনা হয়েছে সৌদি দূতাবাসের নামে। আরেকটি গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় ২ লাখ ডলারে আমদানি করেছে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড। যুক্তরাজ্যের ভারটেক্স অটো লিমিটেড থেকে আনা এই গাড়ির বাজারমূল্য ২৭ কোটি টাকা। অবশ্য গাড়িটি সরিয়ে নেওয়ার পর চট্টগ্রাম কাস্টমস এক আদেশে জানায়, শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না গাড়িটি। তাতে শুল্ক–কর, জরিমানাসহ ৮৫ কোটি টাকা গুনতে হবে আমদানিকারককে।

রোলস রয়েসের পরের অবস্থানে রয়েছে বেন্টলি। গত পাঁচ বছরে বেন্টলি গাড়ি আমদানি হয়েছে ২০টি। বেন্টলি ব্র্যান্ডের একেকটি গাড়ি আমদানির মূল্য পড়ছে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। অর্থাৎ ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের এই গাড়ির শুল্ক–করই সাড়ে ৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গাড়িটি খালাস পর্যন্ত খরচ পড়ছে সোয়া ৫ কোটি টাকা।

আবার পোরশে ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হয়েছে ৪০টি। ইতালির মাসেরাতি ব্র্যান্ডের গাড়ি সংখ্যায় কম হলেও গত পাঁচ বছরে এসেছে ৯টি। জাগুয়ার ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হয়েছে পাঁচটি। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরসের ক্যাডিলাক ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হয়েছে দুটি।

অভিজাত-বিলাসবহুল গাড়ির বাজার বাড়বে

গাড়ি আমদানির পাশাপাশি দেশে এখন সেডান কার ও এসইউভি শ্রেণির গাড়ি সংযোজন হচ্ছে। সংখ্যায় কম হলেও এখন বছরে ৫০০টির মতো গাড়ি সংযোজন হচ্ছে। সরকারি গাড়ি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, বেসরকারি খাতের পিএইচপি অটোমোবাইলস এবং র‍্যাংগস লিমিটেড বিযুক্ত অবস্থায় গাড়ি এনে দেশে সংযোজন করছে।

আর এ বছর জানুয়ারিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে হুন্দাই গাড়ির উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই করপোরেশন ও বাংলাদেশের ফেয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফেয়ার টেকনোলজি যৌথ উদ্যোগে এই কারখানায় এসইউভি গাড়ি তৈরি হচ্ছে।

গাড়ির বাজার নিয়ে জানতে চাইলে গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দুই দশকের ব্যবধানের হিসাব আমলে নেওয়া হলে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুগুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এখন ফ্ল্যাট বা বাড়ি না কিনেও আগে গাড়ি কিনছে মানুষ। প্রায় ১৬ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের এই দেশে গাড়ির বাজারও সামনে আরও বড় হবে। আর উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি বড় হচ্ছে। তাই এই বাজার সামনে রেখে পরিবেশবান্ধব গাড়িতে নীতিসহায়তা আরও বাড়ানো দরকার।