নগরবাসীর অধিকাংশই নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী একটি বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্ন দেখেন। যদিও উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেরই সাধ পূরণ হয় না। তবু প্রতিবছর শহরজুড়ে হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীতে মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। নগরবাসীর অধিকাংশই নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী একটি বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্ন দেখেন। যদিও উচ্চমূল্যের কারণে তাঁদের অনেকেরই সাধ পূরণ হয় না সাধ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে। তারপরও প্রতিবছর শহরজুড়ে হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা থাকায় আবাসন কোম্পানিগুলোও নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছে।
দেশে অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে শুরু করে মূলত নব্বইয়ের দশকে। তখন থেকে আবাসন ব্যবসা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। অন্যদিকে ঢাকার জমির উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগে থেকেই অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশছোঁয়া। তাতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের নিচের মানুষের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কেনাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও এক হাজারের বেশি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। তার বেশির ভাগই ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করে থাকে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তথ্যানুযায়ী, ঢাকার মোট আবাসন চাহিদা তথা প্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের প্রায় ৪২ শতাংশের জোগান দিয়েছেন বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা। মাত্র ৭ শতাংশের জোগান দিয়েছে সরকারি খাত। এ ছাড়া বাকি ৫১ শতাংশ ভবন ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে প্রথম দেড়-দুই মাস আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। তারপর দ্রুতই আবার ঘুরে দাঁড়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যায়। তখন নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়ে। যে কারণে অধিকাংশ কোম্পানিই অ্যাপার্টমেন্ট বা বাণিজ্যিক স্পেসের দাম বাড়িয়ে দেয়। ওই বছরের আগস্টে ঢাকা মহানগরের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-২০৩৫ সাল) কার্যকর হয়। আগে মধ্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, নতুন ড্যাপের কারণে তার ৬০ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে জমির মালিকেরা আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্প করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে আবাসন প্রকল্পের সংখ্যা কমে যায়।
ঢাকার জমির উচ্চমূল্যের কারণে অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশছোঁয়া। তাতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের নিচের মানুষের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কেনাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও এক হাজারের বেশি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে বছরে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করে থাকে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) নেতারা অনেক দিন ধরেই ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁদের চেষ্টা-দাবি সত্ত্বেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে যেসব এলাকায় ভবনের উচ্চতা বেশি পাওয়া যায়, সেখানেই প্রকল্পের সংখ্যা বাড়াচ্ছে আবাসন কোম্পানিগুলো। যেমন পূর্বাচলের জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্পে অনেক কোম্পানি আবাসন প্রকল্প নিয়েছে। ইতিমধ্যে বিক্রিও শুরু করেছে।
বেচাবিক্রি কিছুটা কম
দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমেছে। আবার অনেক গ্রাহক নিয়মিত ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ করছেন না বা করতে পারছেন না। এতে ছোট ও মাঝারি আবাসন প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়েছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে জানান, ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মধ্যাঞ্চলে নতুন জমি পাচ্ছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ফলে তারা নতুন আবাসন প্রকল্প নিতে পারছে না। আগে জমা হওয়া প্রকল্পগুলোই পাস হচ্ছে। বিক্রিও হচ্ছে। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে।
জানতে চাইলে ঐশী প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান আইয়ূব আলী বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অস্থিরতার কারণে ফ্ল্যাট বিক্রি ৩০ শতাংশে নেমেছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। বর্তমানে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ শতাংশ ব্যবসা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। যদিও ড্যাপের কারণে ঢাকার মধ্যাঞ্চলে গত দুই বছরে নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া যায়নি।’ ড্যাপ সংশোধন না হলে ব্যবসা সংকোচন হবে বলে মন্তব্য করেন।
নতুন প্রকল্প কম
এদিকে নতুন ড্যাপের আলোকে ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা করার প্রক্রিয়াটি বর্তমানে চলমান রয়েছে। ২০২২-৩৫ সাল মেয়াদের জন্য চূড়ান্ত হওয়া ড্যাপকে বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে রিহ্যাব। ইতিমধ্যে সংগঠনটি বিধিমালায় কী কী সংশোধন চায়, সেটিও জমা দিয়েছে।
সর্বশেষ অগ্রগতি হলো, সরকার গত ১৫ ডিসেম্বর ড্যাপ বাস্তবায়নে তদারকি ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছে।
ড্যাপের বিষয়টি ফয়সালা না হলেও বসে নেই আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। আগে পাস হওয়া প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বেশি উচ্চতা পাওয়া যাবে, এমন এলাকায় নতুন প্রকল্প হচ্ছে। যদিও সংখ্যাটি কম।
জানতে চাইলে রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, হাতে গোনা কয়েকটি বড় কোম্পানি বসুন্ধরা, জলসিঁড়ির মতো আবাসিক এলাকায় প্রকল্প নিতে পারছে। এই খাতে বেশির ভাগই ছোট ও মাঝারি কোম্পানি, যারা ড্যাপের কারণে ঢাকার মধ্যাঞ্চলে কোনো প্রকল্প নিতে পারছে না। এতে চাহিদা ও জোগানে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাবে। তখন উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া আর কেউ অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে পারবে না।