১ কেজির পাশাপাশি আধা, ২ ও ৫ কেজির প্যাকেটে চিনি নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে সরকারি সংস্থাটি।
দেশের চিনির বাজারে অস্থিরতা কোনোভাবেই থামছে না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, তার থেকে বাড়তি দামে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে। চিনির দামে লাগাম না থাকার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকটসহ নানা কারণ উঠে এসেছে সরকারেরই এক প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে দাম নিয়ন্ত্রণে চিনি শতভাগ প্যাকেটজাত করে বিক্রি করার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
সরকারি সংস্থাটি বলছে, দেশে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৪ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি ও ৫০ হাজার টন পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়ে থাকে। অপরিশোধিত চিনি পরিশোধনের পর বাজারে আসে। বিক্রি হয় ৫০ কেজির বস্তায় ও এক কেজির প্যাকেটে।
প্যাকেটজাত চিনির দাম মোড়কে লেখা থাকে, তাতে সহজে দাম বাড়িয়ে রাখতে পারেন না বিক্রেতারা। তবে ৫০ কেজির বস্তায় ভরে যে খোলা চিনি বাজারে ছাড়া হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে দোকানিরা এক কেজির প্যাকেট করে খুচরায় বিক্রি করেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম রাখেন, যা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে।
এই মুহূর্তে বাজারের যে অবস্থা, তাতে নতুন করে প্যাকেটজাত চিনি নিয়ে আসতে গেলে খরচ আরও বেড়ে যাবে। কারণ, মোড়কজাত করতে আলাদা খরচ আছে। তাতে অস্থিরতা কমানোর যে উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকর না-ও হতে পারে।গোলাম রহমান, মহাসচিব, বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন
এদিকে দাম নিয়ে সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হলে কোম্পানিগুলো বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দেয়। তখন বাজারে কিছু খোলা চিনি ছাড়লেও প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ একেবারে কমিয়ে ফেলে তারা। বিটিটিসির মতে, বর্তমানে বাজারে ৯৫ শতাংশ চিনিই খোলা বিক্রি হয়। বাকি ৫ শতাংশ চিনি প্যাকেটজাত করে ছাড়ে কোম্পানিগুলো। এই ৫ শতাংশ চিনির প্যাকেটের গায়ে দাম উল্লেখ করে দেওয়ার কারণে কোম্পানি থেকে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে রাখতে গেলে ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়েন বিক্রেতারা।
বিটিটিসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে জানিয়েছে, বাজারে চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এক কেজির পাশাপাশি আধা কেজি, দুই ও পাঁচ কেজির প্যাকেটজাত চিনি বাজারে আনা যেতে পারে। আর ৫০ কেজির চিনির বস্তা শুধু করপোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হবে। তাতে খুচরা বাজারে বস্তার চিনি ভেঙে কেজি দরে বাড়তি দামে বিক্রি করার সুযোগ থাকবে না। সরকারিভাবে চিনির যে দাম বেঁধে দেওয়া হবে, তা কার্যকর হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে।
বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে বাজারের যে অবস্থা, তাতে নতুন করে প্যাকেটজাত চিনি নিয়ে আসতে গেলে খরচ আরও বেড়ে যাবে। কারণ, মোড়কজাত করতে আলাদা খরচ আছে। তাতে অস্থিরতা কমানোর যে উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকর না-ও হতে পারে।
বিটিটিসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠিতে আরও জানায়, দেশে শতভাগ চিনি মোড়কজাত করে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই পাইকারি ও খুচরা বাজারে লটে চিনি বিক্রি হচ্ছে। এ ধরনের সেকেন্ডারি মার্কেট সরকার ও মিলমালিকদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ জন্য নিত্যপণ্যের সেকেন্ডারি বাজার নিয়ন্ত্রণে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থায় সেকেন্ডারি ক্রেতারা নিবন্ধিত হয়ে পণ্য কেনাবেচা করলে সরকারিভাবে বাজারে তদারকি বাড়ানো সম্ভব হবে।
সম্প্রতি চিনির বাজারের অস্থিরতা নিয়ে ট্যারিফ কমিশনের তৈরি প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে চিনির সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। সংস্থাটির মতে, পরিশোধন মিল থেকে চিনি সরবরাহে বিশৃঙ্খলার ফলে সৃষ্ট সমস্যা বাজারে চিনির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।
চিনির বাজারে অস্থিরতা থামাতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ট্যারিফ কমিশন সরকারের হয়ে বাজার-সংক্রান্ত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন পাঠায়। তারা চিনির বাজার নিয়ে এমন কোনো সুপারিশ করে থাকলে তা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকাল শনিবারের বাজারদরের তালিকা বলছে, ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। যদিও ক্রেতারা ১৪০ টাকার নিচে চিনি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। দাম কোথাও কোথাও ১৫০ টাকাও রাখা হচ্ছে।
স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় চিনি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হলেও স্থানীয় চিনির উৎপাদন মাত্র ১ শতাংশ। চিনি আমদানি হয় বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত চিনির পরিমাণ মাত্র ৩০ হাজার টনের মতো; অর্থাৎ চিনির বাজার প্রায় পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আবার অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান—সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম।