সাক্ষাৎকার

ইস্পাতের তৈরি অবকাঠামো শিল্পের সক্ষমতা বেড়েছে

ইস্পাতের অবকাঠামো নির্মাণ খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কেআর স্টিল স্ট্রাকচার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তছলিম উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ মিলাদ

মো. তছলিম উদ্দিন, এমডি, কেআর স্টিল স্ট্রাকচার
মো. তছলিম উদ্দিন, এমডি, কেআর স্টিল স্ট্রাকচার
প্রশ্ন

প্রথম আলো: শিল্প খাতে নানামুখী সংকট চলছে। ইস্পাতের ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণশিল্পে এর প্রভাব কেমন?

তছলিম উদ্দিন: করোনার কারণে ২০২০ সালে অন্য শিল্পের মতো এই খাতেও ধাক্কা লাগে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে এই শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আবারও হোঁচট খায় এই শিল্প। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তাতে এই খাতের অনেক প্রকল্পে ধীরগতি নেমে আসে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর এক বছর পার হলেও এই সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি। ডলার–সংকটে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। আবার কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে যে ঊর্ধ্বগতি ছিল, সেটিও কমে এসেছে। অর্থাৎ চাহিদা থাকলেও ইস্পাতের অবকাঠামোর অনেক কারখানা বা বাণিজ্যিক ভবনের প্রকল্প পিছিয়ে যাওয়ায় এই খাতে স্থবিরতা রয়ে গেছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ইস্পাতের তৈরি অবকাঠামো নির্মাণে সুবিধা কী?

তছলিম উদ্দিন: কংক্রিটের একটি ভবন নির্মাণে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। ইস্পাতের ভবন নির্মাণে সময় অনেক কম লাগে। প্রকল্পভেদে কংক্রিটের ভবনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম সময়ে ইস্পাতের ভবন স্থাপন করা সম্ভব। আবার খরচও তুলনামূলক কম। প্রয়োজনে ইস্পাতের অবকাঠামো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়। কংক্রিটের ভবনে যেটি সম্ভব হয় না। আবার প্রয়োজন শেষে ইস্পাতের অবকাঠামো বিক্রি করে ভালো দামও পাওয়া যায়। ভূমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে কংক্রিটের তুলনায় ইস্পাতের ভবনে ঝুঁকি কম। তাই এই শিল্প বেশ পরিবেশবান্ধব।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বর্তমানে এই শিল্পের প্রধান প্রধান সমস্যা কী?

তছলিম উদ্দিন: এই শিল্পের বড় সমস্যা হলো আমদানিতে করভার বেশি। মূল কাঁচামাল আমদানিতে করভার প্রায় ৩০ শতাংশ। অন্যান্য উপকরণ আমদানিতে করভার ৯০ শতাংশ। নির্মাণের যেসব খাত রয়েছে, সেগুলোর চেয়ে ইস্পাতের অবকাঠামো নির্মাণশিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার বেশি। এটি যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা দরকার।

বর্তমানে দেশে যেসব মেগা প্রকল্প হচ্ছে, সেগুলোতে ইস্পাত কাঠামো নির্মাণে অনেক কাজই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা এখন অনেক বেশি। যেসব কাজ এখানেই সম্ভব, সেগুলো সরাসরি আমদানির পরিবর্তে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহের বাধ্যবাধকতা দিলে এই খাতের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়বে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়লে দেশেরই লাভ। কারণ, সামনে এই খাতে বিপুল চাহিদা আছে। অভিজ্ঞতা বাড়লে বিশেষায়িত এ অবকাঠামো নির্মাণে আমদানিনির্ভরতা কমবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এই শিল্পে আপনাদের বিনিয়োগ কেমন?

তছলিম উদ্দিন: বছর পাঁচেক আগেও আমরা ছিলাম এই খাতের অন্যতম গ্রাহক। আমাদের একটি কারখানা ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে দেখি, এই খাতে উদ্যোক্তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আবার ইস্পাতের ভবন নির্মাণে বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। এ শিল্পের সম্ভাবনাও বেশ ভালো। ফলে এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি হয়। আমরা যখন এ শিল্পে বিনিয়োগ করি, তখন চট্টগ্রামে কোনো কারখানা ছিল না। আবার পারিবারিকভাবে আমরা লৌহশিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এই শিল্প স্থাপনে সিদ্ধান্ত নিতে কোনো সমস্যা হয়নি।

২০১৭ সালে আমরা সীতাকুণ্ডের কুমিরায় কেআর স্টিল স্ট্রাকচার কারখানা গড়ে তুলি। এই কারখানায় তৈরি ইস্পাতের উপাদান নিয়ে প্রথমে আমাদের নিজেদের অন্য কারখানার ভবন ও অবকাঠামো গড়ে তুলি। ২০১৮ সাল থেকে আমরা গ্রাহকের কাছ থেকে সাড়া পেয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করি। আমাদের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা এখন ২০ হাজার টন।

কারখানা চালুর পর থেকে আমরা বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্প ও বেসরকারি খাতে বড় বড় শিল্প গ্রুপের কারখানা ভবন, শেডসহ নানা অবকাঠামো সফলভাবে তৈরি করেছি। যেমন সিলেটে দৃষ্টিনন্দন বাসস্টেশন আমরা নির্মাণ করেছি। এ পর্যন্ত ৫৪টি প্রকল্প সফলভাবে হস্তান্তর করেছি আমরা। তবে সংখ্যার চেয়ে আমরা গুণগত মানের দিকে বেশি জোর দিচ্ছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশে এই শিল্পের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

তছলিম উদ্দিন: বর্তমান সংকট বাদ দিয়ে বললে এই শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে এখনো পুরোদমে কারখানা নির্মাণ শুরু হয়নি। যেসব কারখানা হচ্ছে, সেগুলোতে ইস্পাত অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাচ্ছে। পুরোদমে শুরু হলে ইস্পাতের কারখানা ভবন তৈরির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। আবার ইস্পাত অবকাঠামোর বাণিজ্যিক ভবন, বিপণিকেন্দ্রসহ নানা ধরনের অবকাঠামোও এখন বাড়ছে। এর কারণ হলো, কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনের অবকাঠামো নির্মাণকাজ খুব কম সময়ে করা যায়। ফলে সামনে এই শিল্পের বাজার আরও বড় হবে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বড় বড় প্রকল্পের কাজ করে দক্ষতা দেখিয়েছে। অনিয়মিত হলেও রপ্তানি হয়েছে ইস্পাত অবকাঠামোর উপকরণও। অর্থাৎ দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বেড়েছে।