সুদের হার বাজারভিত্তিক করা ও ডলারের দাম বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে। বাড়বে পণ্যমূল্য।
ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ও ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধি ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদ এবং আমদানি ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপের পর এখন কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসার খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, ব্যবসার খরচ বেড়ে গেলে পণ্যমূল্য আরেক দফা বাড়বে। তাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, ফলে সাধারণ মানুষ আরও চাপে পড়বে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারকেরা বলছেন, প্রায় দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারিত একটি সীমার মধ্যে ধরে রাখলেও বাস্তবে কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে তাদের ১১৭ থেকে ১২০ টাকায় ডলার কিনতে হয়েছে। ব্যাংককে অতিরিক্ত দাম পরিশোধ করতে হতো ভিন্ন পন্থায়। এখন ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হওয়ায় ভিন্ন পন্থায় আর বেশি দাম পরিশোধ করতে হবে না। ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধি আপাতত তাদের খুব বেশি চাপে ফেলবে না। তবে ব্যাংকগুলো ডলারের দাম নির্ধারণের নতুন ব্যবস্থা (ক্রলিং পেগ) কীভাবে কার্যকর করছে, তার ওপর নির্ভর করবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বুধবার ডলারের দাম ও ঋণের সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণের শর্ত পালনের অংশ হিসেবে ডলারের দাম ১১০ থেকে একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি ঋণের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি বাতিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়। একই সঙ্গে বেড়েছে নীতি সুদহার। তবে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, সুদ বাজারভিত্তিক হলেও তা যেন বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি না বাড়ে। গত মাসে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
একবারে ডলারের বড় মূল্যবৃদ্ধির সুফল অবশ্য দ্রুতই পাবেন রপ্তানিকারকেরা। একাধিক রপ্তানিকারক বলছেন, যদি ব্যবসার খরচ নতুন করে আর না বাড়ে তাহলে ডলারের বাড়তি দামের সুবিধা রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতাসক্ষমতা অনেক বাড়িয়ে দেবে। তাতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতি লাভবান হবে। তাঁরা মনে করছেন, নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানি আয় যেমন বাড়বে, তেমনি বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধিরও বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ডলার–সংকটের এ সময়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লে তা সংকট কাটাতে কাজে লাগবে।
তবে ডলারের দাম একলাফে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি আমদানির খরচ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাতে বিদ্যুৎ–জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, এ চাপ মোকাবিলায় সরকারকে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ডলারের দাম বাড়ানোর ফলে বাড়তি যে রাজস্ব আদায় হবে, তা থেকে জ্বালানি আমদানির বাড়তি খরচ সমন্বয় করা যেতে পারে। সেটি করা গেলে বিদ্যুৎ–জ্বালানির দাম না বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে।
দেশে বিভিন্ন শিল্প খাতের মধ্যে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর বড় শিল্প রড ও সিমেন্ট খাত। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন আমরা কাঁচামাল আমদানিতে ১১৭–১১৮ টাকার কমে ডলার কিনতে পারছিলাম না। নতুন সিদ্ধান্তে যদি ডলারের কার্যকর দাম এটিই থাকে, তাহলে আমাদের আমদানি খরচ খুব বেশি বাড়বে না। তবে এ সিদ্ধান্তে যদি ব্যবসার অন্যান্য খরচ বাড়ে তাহলে হয়তো কিছুটা চাপ তৈরি হবে।’
সিমেন্টশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ঋণের সুদ বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত ব্যবসার ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা বুঝতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। বিষয়টি নির্ভর করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কীভাবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে, তার ওপর।
অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ডলারের দামে বড় বৃদ্ধি দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে। এ ছাড়া মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, বাংলাদেশ থেকে মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এখন কম অর্থ পাবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ডলার–সংকটের কারণে বিমান পরিবহন সংস্থার অর্থ এবং বিদেশি বহুজাতিক একাধিক কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশ ও মুনাফা লম্বা সময় ধরে আটকে আছে। এসব অর্থ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বেশি দামে ডলার কিনতে হবে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আয় কমবে।
বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন বা আইএটিএর হিসাবে, গত এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিভিন্ন বিমান পরিবহন সংস্থার প্রায় ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বাংলাদেশ আটকে রয়েছে। ডলার–সংকটের কারণে এ অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশে নিতে পারছে না বৈশ্বিক বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো। এখন এ অর্থ নিতে বেশি দামে ডলার কিনতে হবে তাদের।
তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বড় সুবিধা দেবে রপ্তানিকারকদের। তাঁরা বলছেন, যদি ব্যবসার অন্যান্য খরচ না বাড়ে, তাহলে প্রতি ডলারে ৬ থেকে ৭ টাকা বেশি আয় হবে রপ্তানিকারকদের। এতে তাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে।
এ বিষয়ে চামড়া পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মেট্রো চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্ববাজারের যে পরিস্থিতি তাতে ডলারের এ মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের সক্ষমতা বাড়াবে। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যদি পরিবহন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি খরচ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রপ্তানিকারকেরা এর সুফল পাবেন না। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্যবসার অন্যান্য খরচ যাতে না বাড়ে, সে জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার বলেন, দেরিতে হলেও ডলারের দাম বাজারের বাস্তব দামের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদের হারও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদে এসব সিদ্ধান্ত ব্যবসায় চাপ তৈরি করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এর ভালো সুফল মিলতে পারে। তিনি আরও বলেন, ডলারের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে ১৫–১৬ হাজার কোটি টাকা। সেই বাড়তি রাজস্বের একটি অংশ জ্বালানি আমদানির বাড়তি খরচ মেটাতে ব্যয় করা হলে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন না–ও হতে পারে। নতুন করে ব্যবসার খরচ না বাড়লে দীর্ঘ মেয়াদে এ সিদ্ধান্তের সুফল মিলবে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির ওপর কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব রাখবে, তবে অর্থনীতির স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো বিলম্বিত সিদ্ধান্ত। আরও আগে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা ‘কম বেদনাদায়ক’ হতো।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘সুদের হার বাজারভিত্তিক করার কারণে অর্থ ধার করার খরচ বাড়বে। এর ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে। আমরা জানি, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানা রকম খরচ আছে। ঘুষ-দুর্নীতির কারণেও ব্যবসার খরচ বাড়ে। তবে দক্ষতা, সুশাসন, জবাবদিহি, দুর্নীতি হ্রাস—এসব নিশ্চিত করতে পারলে আমরা বিরূপ প্রভাব অনেক কমাতে পারব।’